এই ভদ্রলোক হচ্ছেন নিকোলা টেসলা। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি ওনাকে সর্বকালের সেরা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, উনি যদি সর্বকালের সেরা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকেন, তাহলে বর্তমান সময়ে উনি এত অখ্যাত কেন? সায়েন্স বা বিজ্ঞান নিয়ে যারা সারাজীবন নাড়াচাড়া করেছেন, এমন অনেক ব্যক্তিও নিকোলা টেসলার নাম হয়তো কোনোদিন শুনেন নি, আর শুনলেও উনি যে আসলে কী কী কর্মকাণ্ড ও আবিষ্কার করেছেন, সে বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ। অনেকের ধারণা উনি তাড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিষয়ে কিছু কাজকর্ম করেছেন – কিন্তু সেগুলো আসলে যে কী, সেটা সঠিকভাবে বলতে পারবে, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। এমনকি যাঁরা তড়িৎ প্রকৌশল বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা বা গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী অর্জন করেছেন, তাঁরাও টেসলাকে একজন ছোটোখাট বিজ্ঞানী হিসেবেই চিনেন; তিনি যে আসলে আইনস্টাইনের সমপর্যায়ের একজন বিজ্ঞানী তথা সর্বকালের সেরা তড়িৎ প্রকৌশলী সেটা হয়তো বিলকুল জানতেন না বা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেন নি।
জেনে রাখুন, ওনার অখ্যাত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো, উনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের এমন এক অঞ্চলে যা বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া নামে পরিচিত। প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষে তিনি আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং সেখানেই তাঁর জীবনের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছিলেন। বিদ্যুৎ আবিস্কৃত হওয়ার পর সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কারগুলো, যেমন – এসি জেনারেটর, এসি মোটর, ট্রান্সফর্মার, ট্রান্সমিশন লাইন, রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ – এ সবকিছুই তাঁর হাত ধরে এসেছে (টেসলার রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ-ব্যবস্থার পেটেন্টের অবৈধ ব্যবহার করেন মার্কনি; এ বিষয়ে আমেরিকান আদালত প্রথমে মার্কনির পক্ষে রায় দিলেও পরবর্তীতে টেসলাই রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ-ব্যবস্থা আবিষ্কারের যোগ্য দাবীদার বলে চূড়ান্তভাবে মেনে নেয়)। এমনকি বর্তমান যুগে ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনেশিয়েটিভ’ নামে যে ব্যবস্থা প্রতিপক্ষ দেশের মিসাইল থেকে শুরু করে এটম বোমা পর্যন্ত আটকে দিতে পারে, সে ব্যবস্থা বা সিস্টেমের প্রথম রূপকার হলেন টেসলা (কথিত আছে যে, টেসলার মৃত্যুর পর আমেরিকান সরকার অবৈধভাবে তাঁর কাগজপত্রগুলো ব্যবহার করে উক্ত সিস্টেম ডেভেলপ করা শুরু করে, আর পরবর্তীতে রাশিয়া থেকে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ভাইপো এসে তাঁর সেই কাগজপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে রাশিয়ান সরকারের হাতে তুলে দেন, এভাবে রাশিয়াও উক্ত সিস্টেম ডেভেলপ করতে সমর্থ হয়)।
কর্মজীবনে এত অর্জন ও সাফল্য থাকা সত্ত্বেও উনি মৃত্যুর পর খুব একটা প্রচার পান নি। এর প্রধান কারণ হলো, উনি জন্মগতভাবে যেহেতু রাশিয়ার নাগরিক, তাই পশ্চিমা মিডিয়া বিশেষ করে আমেরিকান মিডিয়া ওনার নাম প্রচার করতে চায় নি। এছাড়া আরো একটা কারণ রয়েছে, সেটা খুলে বলা যাক। ওনার একবার নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, ১৯১০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে; কিন্তু পুরষ্কারটা শেয়ার করতে হবে তথাকথিত অামেরিকান দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সাথে। এই ব্যক্তির সাথে টেসলার তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়েছিল টেসলা যখন এডিসনের কোম্পানিতে কাজ করতেন তখন থেকে। এডিসন টেসলাকে তাঁর ডিসি মোটরের পারফরমেন্স বাড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। টেসলা তাঁর দায়িত্ব সম্পন্নের পর যখন পারিশ্রমিক চাইলেন, তখন এডিসন তাঁর সাথে উপহাস করলেন এবং প্রতিশ্রুত অর্থের চেয়ে অনেক কম পারিশ্রমিক দিতে চাইলেন। এ অপমান টেসলা সহজভাবে নেন নি। তিনি অভিমান করে চাকুরি ছেড়ে দেন, ফলশ্রুতিতে পরবর্তী এক বছর তাঁকে মাটি কাটার কাজ করতে হয়। এমনকি টেসলা যখন সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সফল বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, তখনো তাঁর সাথে নতুন করে এডিসনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এবারের দ্বন্দ্বের কারণ এসি কারেন্ট আর ডিসি কারেন্ট নিয়ে মতবিরোধ। টেসলা ছিলেন এসি কারেন্টের সমর্থক, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ডিসি কারেন্ট দিয়ে যে কাজগুলো সম্ভব নয়, সেগুলো এসি কারেন্ট দিয়ে সম্ভব, যেমন দূরদূরান্তে বিদ্যুৎ প্রেরণ করা। সুতরাং এই আজীবন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে নোবেল পুরষ্কার শেয়ার করা টেসলার পক্ষে সম্ভব নয় – এটা তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। এডিসনও অনুরূপ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এডিসন যেহেতু জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক, আর টেসলা ছিলেন প্রবাসী থেকে নাগরিক, তাই আমেরিকান তথা পশ্চিমা মিডিয়ার সাপোর্ট ছিল এডিসনের পক্ষেই।
এই রচনার প্রথম অনুচ্ছেদে টেসলাকে আইনস্টাইনের সমপর্যায়ের বিজ্ঞানী বলা হয়েছে, এটি অতিরঞ্জিত কিছু নয়; কারণ দু’জনেই প্রায় সমান মেধাবী ছিলেন। এর মধ্যে টেসলা ছিলেন ব্যবহারিক বিজ্ঞানী অর্থাৎ তিনি বস্তুজগত নিয়ে কাজ করতেন আর আইনস্টাইন ছিলেন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী। আইনস্টাইন যদিও টেসলাকে অনেক পছন্দ করতেন এবং সর্বদাই তাঁর প্রশংসা করতেন, তবে টেসলা আইনস্টাইনকে ভালো চোখে দেখতেন কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একবার তো তিনি আইনস্টাইনকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘আজকালকার তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা গভীর চিন্তা করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা পরিষ্কার (সঠিক) চিন্তা করতে পারেন কিনা, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’ টেসলার এই বক্তব্য নিতান্ত অমূলক নয়। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব আবিষ্কারের বহুকাল পরে আইনস্টাইন নিজের হিসাবনিকাশগুলোর দিকে আরেকবার ভালো করে চোখ বুলান, তাতে তিনি একটি বৃহৎ ভুল দেখতে পান। এবার বুঝলেন তো, যেকোনো তত্ত্ব বা থিওরি যতই বিখ্যাত হোক না কেন, সেখানেও একটা ‘গোড়ায় গলদ’ থাকতে পারে।
যাই হোক, এবার টেসলার জীবনযাপন নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৬ সালে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৩ সালে। জীবদ্দশায় তিনি অনেক অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু তিনি প্রায় সব অর্থই বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেন এবং ব্যাংকে তেমন কোনো টাকাপয়সা রাখেন নি। যার ফলে শেষ বয়সে তাঁকে অনেক খারাপ সময় পার করতে হয়েছে, এমনকি যৌবনে যে কোম্পানিগুলোর জন্য তিনি কাজ করেছেন, সেগুলো থেকে তাঁকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। ঐ সকল কোম্পানিগুলোর উত্থানের পেছনে তাঁর যে বিশাল অবদান ছিল, সে কথা মাথায় রেখেই তারা তাঁকে এই আর্থিক সাহায্যটুকু করতো।
নিকোলা টেসলা ৮৭ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন; আরো কিছুদিন হয়তো বাঁচতেন, কিন্তু উনার বয়স যখন ৮৩ বছর, তখন নিউইয়র্কের রাস্তায় একটা ট্যাক্সি তাঁকে আঘাত করে। এর কয়েক বছর পরেই রোগেশোকে ভুগে উনি মারা যান। পরিশেষে বলতে পারি, উনি হয়তো ক্রিশ্চিয়ান ছিলেন, তারপরও মানবতার কল্যাণে উনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশাল অবদান রেখেছেন, সে কথা স্মরণ করে হলেও আমরা সকলে উনার রূহের মাগফিরাত (Redemption) ও শান্তি কামনা করতে পারি।