মুসা (আঃ) ফেরাউনের রাজপরিবারে লালিতপালিত হয়ে বড় হয়েছিলেন। তাঁকে ‘ছোট রাজপুত্র’ নামে ডাকা হতো, আর বড় রাজপুত্র ছিলেন রেমেসিস, যিনি মুসলমানদের কাছে কুখ্যাত ‘ফেরাউন’ নামে পরিচিত। তাঁরা দু’ভাই অনেক মজা করেই তাঁদের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য পার করেছেন। রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে একসময় মুসার মনেও প্রচণ্ড অহংকার ছিল। একদিন তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর আপন বড়বোন মরিয়ম আর বড়ভাই হারুন (আঃ) তাঁকে আস্তে করে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেলেন। তাঁরা ছিলেন হতদরিদ্র (বনী-ইসরাইল বংশের ক্রীতদাস)। তারপরও তাঁরা সাহস সঞ্চয় করে জানালেন যে, তাঁরাই হলেন মুসা (আঃ)-এর সত্যিকার ভাইবোন আর তিনি মূলতঃ ‘পালক সন্তান’ হিসেবে ফেরাউনের পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন। একথা শোনার পর মুসার মাথা গরম হয়ে গেল; তাঁর কিছুতেই বিশ্বাস হলো না যে, যাদেরকে এতদিন তিনি পিতামাতা হিসেবে জেনে এসেছেন, তাঁরা তাঁর সত্যিকার পিতামাতা নন। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজপ্রাসাদে ছুটে গেলেন এ ব্যাপারে ফেরাউনকে জিজ্ঞেস করতে। যাবার সময় রাজপ্রাসাদের দেয়ালে বেশকিছু চিত্রকর্ম দেখতে পান যেগুলো পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করছিল কীভাবে একসময় ফেরাউনের লোকজন বনী-ইসরাইল বংশের শিশুদেরকে অমানুষের মতো মেরেছে। তিনি তখনই মরিয়ম আর হারুনের কথার সত্যতা বুঝতে পারলেন। তারপরও তিনি এ বিষয়ে ‘পিতা’ নামধারী ফেরাউনকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও এর সত্যতা স্বীকার করেন।
তখনই মুসা (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, এ রাজপ্রাসাদে থাকার আর কোনো মানে হয় না। এতদিন যাদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা করেছেন, শেষ পর্যন্ত জানতে পারলেন যে, তিনি তাদেরই একজন। তিনি তখন উদভ্রান্তের মতো রাস্তায় নেমে গেলেন। নেমে কিছুদূর হাঁটতে না হাঁটতেই দেখতে পেলেন যে, এক ‘দাস-নিয়ন্ত্রক’ অমানুষের মতো এক দুর্বল অসহায় দাসকে চাবুক দিয়ে পিটাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মুসার মাথা আরো গরম হয়ে যায়। তিনি তখন গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঐ ‘দাস-নিয়ন্ত্রক’কে উঁচু স্থান থেকে ফেলে দিলেন। একেতো পরিবার আর সম্মান হারানোর গ্লানি, তার উপর খুনের শাস্তির ভয়ে তিনি তখন রাজধানী ছেড়ে মরুভূমির বালুকাময় পথ ধরে অজানার উদ্দেশ্যে এলোমেলো হাঁটতে থাকেন। একসময় তিনি এক মরুঝড়ের কবলে পরে বালুর নিচে চাপা পরেন, সেখান থেকে এক উট তাঁকে উদ্ধার করে। উটের আরোহী যখন পানি পান করছিল, তখন তার ছিঁটাফোটা নিচে পরে, তা-ই পান করে জীবন বাঁচালেন তিনি। এরপর আবার অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকেন। পথিমধ্যে দু’-তিন জন ব্যক্তি কয়েকটি ছোট বালিকার সাথে রাহাজানি করছে – এই দৃশ্য দেখতে পেলেন। মুসানবী তাঁর সহজাত কৌশল ও বুদ্ধি খাঁটিয়ে কোনোরকম মারপিট ছাড়াই ঐ বালিকাদেরকে সেই রাহাজানির হাত হতে রক্ষা করলেন। কিন্তু ঠিক এর পরপরই তিনি অতিরিক্তরকম ক্লান্ত-বিধ্বস্ত থাকায় একটি ভাঙ্গা কুয়ায় পরে যান, যেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে ঐ বালিকাদের পিতার গৃহে আশ্রয় দেয়া হয়। সেখানেই তিনি কিছুকাল অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বালিকাদের পিতাকে তার সওদাগরি কাজ-কর্মে সহযোগিতা করা শুরু করলেন। পরবর্তীতে ঐ ব্যক্তির বিবাহযোগ্যা এক কন্যাকেই শাদি করেন মুসা (আঃ)। এর পরের কয়েক বছর তাঁদের সাংসারিক জীবন বেশ ভালোই কাটতে থাকে। শেষে তিনি যখন নবুওয়্যত প্রাপ্ত হলেন, তখন তাঁর জীবন ভিন্ন দিকে মোড় নিল।