মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দেবে, আমারে বলেন কেন?

মনটা কদিন ধরেই ভালো নেই। অবশ্য যে অদ্ভুত দেশে বসবাস করি সেদেশে মনমেজাজ একটানা ভালো থাকবে সেটাও অস্বাভাবিক। মন খারাপ হলে আপনারা কে কী করেন সেটা জানি না, তবে আমি কি করি-সেটা বলতে পারি।

প্রথমেই মোবাইলটা অফ করি, মাঝে মাঝে রমনা পার্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে থাকি, কিছু বাদাম ছড়িয়ে দিলে দুয়েকটা কাঠবিড়ালী চলে আসে, এরা কী আশ্চর্য সুন্দর করে বাদামগুলো দুহাতে ধরে নিয়ে খায়! এদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে।

মন খারাপের ব্যক্তিগত নানা ঘটনা বাদ থাকুক, চিকিৎসক হিসেবে যে কারণে মন খারাপ -সে ঘটনাটা বলি…



সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকাল সকাল এক যুবক সাথে করে এক বয়স্ক মহিলা ও এক তরুণীকে নিয়ে আমার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। বয়স্ক মহিলাটি হাই-প্রেশারের রোগী, বিষয়টা নিয়ে যুবক ও তরুণী বেশ উদ্বিগ্ন। প্রেশার চেক করলাম, একটু বাড়তির দিকে। বয়স্ক মহিলাটি প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন, ডোজটা বাড়িয়ে দিয়ে কি করতে হবে আর কি করা যাবে না সে ব্যাপারে কিছু কথা বলে রোগীটি দেখা শেষ করলাম।

যুবকটি আমার প্রতিটা কথা বেশ দায়িত্ব নিয়ে বুঝে নিলেন, আমার সামনেই বেশ তরল গলায় বয়স্ক মহিলাকে কয়েকবার ‘মা’, ‘মা’ডেকে তাকেও বুঝিয়ে দিলেন। তাদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম বয়স্ক মহিলাটি তার শাশুড়ি, তরুণীটি তার স্ত্রী।

যুবকের রেসপনসিবিলিটিতে আমিও তখন বেশ মুগ্ধ, এমনকি মহিলার সামনেই বলে ফেললাম, ‘আপনার ভাগ্য তো বেশ ভালো! এমন জামাই কি সবার ভাগ্যে জোটে?’

মহিলা ও তরুণী হাসিমাখা মুখে সেটা স্বীকারও করে নিলেন।

যুবকটি ভিজিট দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় আমাকে জানালেন ঘন্টাখানেক পর যুবকটির মা’ও আসবেন, আমি যেন একটু দেখে দেই…

যুবকটির মায়ের কথা রোগী দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম। চেম্বার শেষ করে উঠতে যাবো, এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলা রুমের দরজা ও দেয়াল ধরে ধরে আমার রুমে ঢোকার চেষ্টা করলেন। আমার মনে আছে ঐ বৃদ্ধা বেশ দুর্বল ছিলেন, উনাকে চেয়ারে বসানোর জন্য আমাকে উঠে যেতে হয়েছিলো।

এই বৃদ্ধা আসলে ঐ যুবকটির মা। ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, শ্বাসকষ্ট আগে থেকেই ছিলো, ইদানিং পায়ে পানি চলে আসছে, সে কারণেই ডাক্তারের কাছে আসা। অনিয়মিতভাবে চিকিৎসা নিতেন। প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে কিডনী সংক্রান্ত দু’তিনটা পরীক্ষা দিতে হলো। ভিজিট দেবার সময় উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, অবাক হয়ে বলেছিলেনঃ ” আমার বাজান কি টাকা দিয়া যায় নাই!”




আমাকে বলতে হয়েছিলোঃ ” আপনার ছেলের মনে হয় ভুল হয়েছে। সমস্যা নেই, পরেরবার আসলে আপনার ছেলে থেকে নিয়ে নিব…”

তবে ছেলে যে ভুল করেনি সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম ছেলের ভিজিট না দেয়াটা ছিল ইচ্ছাকৃত…

মাসদুয়েক পর যুবক আবারও এসেছিলেন তার শাশুড়িকে নিয়ে, আগের মতই শাশুড়ির চিকিৎসা নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ উদ্বিগ্ন। চলে যাবার সময় একান্তে ডেকে তার মায়ের ভিজিটের কথা বললাম। উনি উষ্মার স্বরে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা আপনাদের শোনাইঃ “মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দিবে, আমারে বলেন কেন?”

অপেক্ষাকৃতভাবে সুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে স্ত্রী সমেত যুবকটি হাজির হতে পারলেও ছানি পড়া অধিকতর দুর্বল নিজের জন্মদাত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসার সময় যুবকটির হয় নি। শাশুড়ির ক্ষেত্রে ভিজিট দিতে যুবকটি কার্পণ্য করেনি, কৃপণতা তিনি দেখিয়েছেন তার জন্মদাত্রীর প্রতি…

বৃদ্ধা মহিলা পরবর্তীতে আরো দু’বার সম্পূর্ণ একা একাই আমার কাছে এসেছিলেন, একা না এসে উপায়ও নেই, স্বামী মারা গিয়েছে অনেকদিন আগে। ততদিনে পায়ের ফোলা আরো বেড়েছে, তেমন কোন ওষুধও নেন নি, পরীক্ষাগুলোও করান নি। কেন ওষুধ ঠিকমত নেন না জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন, ‘বাজান তো ওষুধ কিন্যা দেয় না। ওর কি দোষ কন! বউ-বাচ্চা নিয়া কত খরচের সংসার!’

বৃদ্ধা এর পরে যে দু’বার এসেছিলেন সে দু’বারই সর্বমোট ২০০-৩০০ টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন, আমার ভিজিটটাও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, “বাজান” কে হয়ত ভিজিট সংক্রান্ত ব্যাপারে ডাক্তারের সামনে আর অপমানিত হতে দিতে চাননি। আমার সঙ্গেবৃদ্ধার আর দেখা হয় নাই…

এসব ঘটনার পর সাত-আট মাস পার হয়েছে। গত শুক্রবার ঐ যুবক আবারো তার শাশুড়ি আর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। শাশুড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে উনার তৈলাক্ত ভাব আরো বেড়েছে। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষে কৌতুহল বশত একবার জিজ্ঞেস করলাম: ‘আপনার মা কেমন আছেন?’ উনি আনন্দিত চেহারা নিয়ে বললেন (I repeat, উনি আনন্দিত চেহারা নিয়েই কথাটা বলেছিলেন): “মা তো মারা গেছে আরো মাস চারেক আগে! মারা গিয়া অবশ্য ভালোই হইছে, তার জন্যে সবার অনেক কষ্ট হইতেছিলো”

আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলাম। আহারে! যে মা তাকে “বাজান” ছাড়া কখনও সম্বোধন করেন নাই, সেই “বাজানে”র কথাটা কি ঐ মা পরপার থেকে শুনতে পেয়েছেন? ঐ মা কি শুনতে পেয়েছেন যে মৃত্যুর আগমুহূর্তে তার জন্য নাকি সবার কষ্ট হচ্ছিলো? “বাজান”-কে কষ্ট থেকে মুক্ত করতেই কি তিনি তাড়াতাড়ি ওপারে চলে গেলেন? আমার চিন্তার রাজ্য কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো।

প্রেসক্রিপশন নিয়ে বৃদ্ধার ছেলে হাসিমুখে তার শাশুড়িকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। মনে অনেক কথা ছিলো, মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ক্লান্ত পথিকের মত ঝিম মেরে তাদের গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম, পথিক শুধু দেখে যায়, কিছু বলা তার শোভা পায় না…



চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে কঠিন কাজ কি জানেন? মানুষের সঙ্গে সঙ্গেমানুষরূপী কিছু অমানুষের চিকিৎসাও আমাদের করতে হয়। সে বড় কঠিন কাজ!

চিকিৎসকদের আপনারা পশু বলেন, অমানুষ বলেন–তাতে এখন খুব একটা কষ্ট পাই না, আপনারা মানুষ থাকলেই আমরা অনেক খুশি। দিনের পর দিন শত-সহস্র সত্যিকার মানুষদের চিকিৎসা দিতে আমরা চিকিৎসকরা কিন্তু ক্লান্ত হই না, “মানুষরূপী অমানুষ”দের চিকিৎসা দিতে আমাদের যে বড্ড কষ্ট হয়…

লেখক:ডা. জামান অ্যালেক্স, বিসিএস মেডিকেল অফিসার

কনটেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস
সূত্র: যুগান্তর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.