জানি, এ প্রশ্নটি যাঁদেরকে করা উচিত, বা যাঁরা এটার জবাব দিতে পারবেন, তাঁরা কেউই আর সম্ভবত বুয়েটে কর্মরত নেই; হয়তো রিটায়ার করেছেন বা মারা গেছেন। যে নির্দিষ্ট জেলার কথা বলছি, সেটা হলো চাঁদপুর। বুয়েট ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বিল্ডিং-এ যে সকল স্টাফগণ কাজ করেন, তাদের মধ্যে চাঁদপুরের লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, একেবারে চোখে পড়ার মতো। এছাড়া হলসমূহে ক্যান্টিন ম্যানেজার থেকে শুরু করে দোকান মালিক ও ক্যান্টিন বয়রা পর্যন্ত দেদারসে চাঁদপুর থেকে এসেছে। আমি যখন বুয়েটে ছিলাম (আমি ‘৯৯ ব্যাচের) তখন বিষয়টি পুরোপুরি প্রযোজ্য ছিল। এখন সেটা একই রকম আছে কিনা, ইয়াং বুয়েটিয়ানদের মধ্যে কেউ জানাবেন কি?
এখন প্রশ্ন হলো, ক্যাম্পাস ও হলসমূহ এভাবে চাঁদপুরের লোক দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে কে? এজন্য কে দায়ী? বুয়েটের কোনো শিক্ষক বা ক্ষমতাশালী কেউ? এ কাজটা কি ঠিক হয়েছে? আমি প্রায়ই দেখি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট জেলা বা এলাকার লোকজন দিয়ে সয়লাব। যেমনঃ বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেখানখার অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট টাইপ স্টাফদের মধ্যে পাবনা ও নাটোরের লোকজন মোর দ্যান ৮০%। এটা দৃষ্টিকটু। বুয়েটের ক্ষেত্রে এজন্য দায়ী হতে পারেন ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক ড. আমিনুল হক। প্রাক্তন বললাম এই কারণে যে, তিনি বর্তমানে সম্ভবত টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি।
স্যারের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে, একারণে আন্দাজ করি, সম্ভবত তিনিই বুয়েটের পরিবেশ চাঁদপুরের মতলবের লোকজন দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া তিনি ক্লাসে এসে সবসময়ই বলতেন যে, তিনি নাকি লোকজনকে অহরহ চাকুরী-বাকুরি দিতেন, আর লোকজনও নাকি লাইন ধরে তাঁর কাছে আসতো।
এবার থলের বিড়াল বের করি। আসলে আমি নিজেও চাঁদপুরের লোক, তবে চাঁদপুর সদরের। বুয়েটে চাঁদপুরের এত লোক দেখে খুশি হয়েছে কিনা হয়তো জানতে চাইবেন। আসলে চাঁদপুরে আমি সর্বসাকুল্যে দুই থেকে আড়াই বছর কাটিয়েছি, শৈশবে। এর পরের দুই বছর পরিবারের সাথে খুলনায় কাটিয়েছি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকায় আছি (কেবল গত দুই বছর বাদে, এসময়টা আমি রূপগঞ্জে ছিলাম, সেটাও তো এক প্রকার ঢাকা-ই, তাই না?)।
তাছাড়া আরো কারণ আছে, বুয়েটের চাঁদপুরের এই লোকগুলোর সাথে নিজের খুব বেশি মিল না পাওয়ার। তারা ৯০% ই মতলব এর (উত্তর ও দক্ষিণ), যেখানকার এমপি হলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। আমি যতদূর জানি, স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি এ এলাকার এমপি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, সৌদি আরব আর বাংলাদেশের মতো চাঁদপুরের মতলবেও গণতন্ত্রের কোনো বালাই নেই, সেখানে বহুদিন ধরে চলছে পরিবারতন্ত্র।
এরকম পরিবেশে যেসব মানুষ বড় হয়, তারা পারস্পরিক বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ শিখে না, বেপরোয়া ও অসভ্য হয়। আপনি চাইলে যাচাই করে দেখতে পারেন যে, সমগ্র চাঁদপুরের মধ্যে মতলবই হলো একমাত্র এলাকা যেখানে ছিনতাই ও কিডন্যাপ পর্যন্ত হয়। তাই মতলবের মানুষকে আমি একটু অন্য চোখে দেখি।
তবে আমি বুয়েটে যখন পড়তাম, তখন এতো কিছু জানতাম না। আশেপাশে সর্বত্র চাঁদপুরের লোকজন দেখে একটু বিব্রত হতাম সহপাঠীদের কারণে। তারা পদে পদে আমাকে মনে করিয়ে দিতো যে, বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়া ও হলের ক্যান্টিনসমূহের বেশিরভাগ স্টাফ ও বয় চাঁদপুরের। এটা তারা করতো আমাকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যেই। এমনকি সোহরাওয়ার্দী হলে আমার এক ক্লাসমেটের কাছে এক গেস্ট আসেন খুলনা থেকে, খুলনাতেই তাঁর বাড়ি। তাঁর সুন্দর চেহারা দেখে কিছুটা চমকপ্রদ হয়েছিলাম। ভাবলাম, লোকটি হয়তো ভালো, তাঁর সাথে পরিচিত হই এবং আলাপচারিতা করি। কিন্তু পরিচয়ের শুরুতেই তিনি আমার হোম ডিসট্রিক্ট জানতে চাইলেন এবং সেটা জানার পর তৎক্ষণাৎ তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ করে বললেন যে, বুয়েটের বেশিরভাগ ক্যান্টিন বয় হলো চাঁদপুরের। এটা শুনে উপস্থিত লোকদের সামনে আমি যারপরনাই বিব্রত হলাম। কিন্তু আমার সে ক্লাসমেট তাঁর অথিতিকে তিরষ্কার জাতীয় কোনো কিছু বললো না, বা করলো না। সে হয়তো নিজেও চারপাশে চাঁদপুরের এত বয় আর স্টাফ দেখে দেখে বিরক্ত।
যাই হোক, পুরো ক্যাম্পাসটা একটা নির্দিষ্ট জেলার লোকজন দিয়ে ভরপুর না থাকলে আমাকে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। শুধু আমি কেন, আমি যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি এবং আন্দাজ করি – এ পরিস্থিতির কারণে বুয়েটে চাঁদপুরের অন্যান্য শিক্ষার্থীবৃন্দকেও প্রায়ই কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাই সবাইকে অনুরোধ করবো, নিজের কর্মস্থল বা অফিস নিজ এলাকার লোকজন দিয়ে ভরে ফেলবেন না। ব্যাপারটা আপনার জন্য সুখকর হলেও অনেকের জন্য হয়তো বিব্রতকর হবে।