লোকজন বুয়েটে ভর্তি হয়ে খুশি হয়, কিন্তু আমি বেশি খুশি হতে পারি নি। কারণ আমি যে ডিপার্টমেন্ট ডিজার্ভ করতাম, সেটা ভর্তি পরীক্ষার সিটিং প্ল্যানের গলদের কারণে আমার ‘কপাল’ থেকে ছিটকে যায়। এর পরই একের পর এক গজব নেমে আসতে থাকে আমার জীবনে। যদি শুনতে আগ্রহী হোন, তাহলে বলছি।
বছরের শুরুতেই মা-খালার তুমুল ঝগড়া
আমার মা’র আপন ছোটবোন আমাদের বাসার খুব কাছেই থাকতেন। কী উদ্দেশ্যে তাঁরা এ এলাকায় ভাড়া এসেছিলেন, সেটা আজও জানি না। খালার দুইটা মেয়ে ছিল, আমার চেয়ে ২ আর ৪ বছরের ছোট। মা চাইতেন না, আমি তাদের বাসায় যাই এবং তাদের সাথে মিশি। আর এদিকে খালাও আমাকে তাঁর বাসায় যেতে টানাটানি করতেন, খালাতো ভাইবোনদের পড়া দেখিয়ে দিতে। ফলে আমি পড়লাম দোটানায়। তাই পড়াশোনার মাঝে খুব বোর হয়ে গেলে মাঝে মাঝে লুকিয়ে তাদের বাসায় যেতাম।
এটা আমার মা জেনে ফেললেন, শুরু হলো তাঁর এবং তাঁর বোনের ঝগড়া, যেটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সময়টা ২০০০ সালের জানুয়ারী মাসের শুরুর দিকে। সামনের ২২ তারিখে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষা, এমন সময় এ ধরনের ক্যাঁচাল আমার সহ্য হলো না। মা’র উপর মাইন্ড করে তাঁকে মুখের উপর বলে দিলাম, ‘আপনি আমার সাথে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার দিন যাবেন না!’ ব্যস্, এতেই বোধ হয় তাঁর অভিশাপ লেগে গেল আমার উপর।
সিটিং প্ল্যানে সমস্যা
ভর্তি পরীক্ষার দিন সাথে বাবা গেলেন। পরীক্ষার প্রথম ২০-২৫ মিনিট ভালোই ছিল, বেশ কয়েকটা ফিজিক্স ম্যাথ নির্বিঘ্নে উত্তর করলাম। এবার ইনভিজিলেটর এসে আমার খাতায় সিগন্যাচার করার সময় বললেন, ‘তোমার চেহারার সাথে তোমার ছবির মিল নেই কেন?’ আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম, এটা আমার ছবি না, ইন ফ্যাক্ট ফরমটাই আমার না।
তখন ইনভিজিলেটর গিয়ে তাঁর কলিগের সাথে ফিঁসফাঁস শুরু করলেন, আর আমি পড়ে গেলাম টেনশনে। ‘তাঁরা শেষ পর্যন্ত আমাকে পরীক্ষা দিতে দেবেন তো? কোথায় গড়বড় হলো? আমাকে ভুয়া পরীক্ষার্থী মনে করে হল থেকে বের করে দিবে না তো?’ এদিকে আমি আবার মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নিই নি, ফলে বুয়েটই ছিল আমার একমাত্র ভরসা। ভর্তি হতে পারার কথা ছিল, কারণ ওমেকার চূড়ান্ত মেরিট লিস্টে আমার প্লেস হয়েছিল ১৩, যেখানে ১৫/১৬তম রা বুয়েটের মেরিটে ৪৫/৫০ নম্বর প্লেস করেছিল।
স্বাস্থ্যের অবস্থা ছিল যাচ্ছে তাই খারাপ (ওজন ৪৩ কেজি), তাই টেনশনের চোটে মাথাটা গেল গরম হয়ে, অংকগুলো সব ওলট-পালট করে ফেললাম। ফলে যেখানে মেরিট হওয়ার কথা ৪০ এর মধ্যে, সেটা গিয়ে ঠেকলো ১৭৫ এ। কোনো মতে ইলেকট্রিক্যাল পেলাম। তখনকার দিনে সিএসই ছিল ফার্স্ট চয়েস, আমারও সেটা পড়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল। কপালের ফেরে সেটা হয় নি, এখন খালি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
উল্লেখ্য যে, ভর্তি পরীক্ষায় আমার মাথা গরম করে দেয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর সেই পরীক্ষার্থীকে পাওয়া গেল, যার সাথে আমার সিটের ইন্টারচেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। তখন অন্য রুমে গিয়ে তার সিটে বসে পরীক্ষার বাকিটুকু দেই। বলা বাহুল্য, তখন I was way over my head.
জীবনটা তছনছ করে দিল একটা ভুল সিটপ্ল্যান, ইলেকট্রিক্যাল ছিল আমার জন্য পুরো মিসম্যাচ। যেভাবেই হোক, যেখানেই হোক, আমার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল – প্রোগ্রামার হওয়া, যার প্রমাণ পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার পেয়েছি। সেগুলো পরে অন্য কোনো পোস্টে শেয়ার করবো।
বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছেলে নিয়াজ মারা গেল
নিয়াজ ছিল নটর ডেমে গ্রুপ ওয়ানে আমার ক্লাসমেট। ও শুধু ক্লাসমেটই ছিল না, ও ছিল আমার পড়াশুনার, ভালো করার ইন্সপাইরেশন। ও ছিল অসম্ভব রকমের মেধাবী। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় তো প্রতি বছরই কেউ না কেউ ফার্স্ট হয়, তাই না? কিন্তু ও ছিল এক্সেপশনাল।
নটর ডেমে প্রথম সেমিস্টারে ফার্স্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে একটু পিছিয়ে গেলেও সে ম্যাথ সলুশনের দিক থেকে ছিল আমাদের ব্যাচে পুরো বাংলাদেশে এক ও অদ্বিতীয়। সেটা আমরা নটর ডেমিয়ানরা খুব ভালো করেই জানতাম। আরো জানতাম যে, নিয়াজ ছাড়া আর কেউ বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে না। সেটা সে হয়েছিলও। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারীর ২০-২৫ তারিখে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল, আর মার্চেই নিয়াজ মারা গেল। সে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একদিনও ক্লাস করতে পারলো না। সম্ভবত টাইফয়েড বা এ টাইপের কোনো একটা অসুখই কাল হলো ওর জন্য।
ঐ সময়টায় মাইলসের নিম্নোক্ত গানটা খুব শুনতাম। আজও যখন এ গানটা শুনি, তখন নিয়াজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুলে অর্থাৎ বুয়েটের স্কুলের ছাত্র ছিল সে, যেটা আজিমপুর কবরস্থানের খুবই কাছে। শেষে আজিমপুরেই তার শেষ ঠিকানা হলো!
সিলেটে গেছিলাম বেড়াতে, ফলে খেলাম ‘বাঁশ’
ঢাকা ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রয়োজন ছিল না, তবু করলাম। স্কুল লাইফের এক ফ্রেন্ড খুব আব্দার ধরলো, তার পাশে বসে তাকে পরীক্ষার খাতা (এমসিকিউ) দেখাতে হবে। করলাম সেটা, তাকে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। বায়োলজিটাও যদি আমারটা দেখে লিখতো, তাহলে সিএসই বা ফার্মেসী পেয়ে যেত।
কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে সিলেটে আমাকে নিয়ে গেল বেড়াতে, তার খালার বাসায়। প্ল্যান ছিল সেখানে দু’-তিন থেকে কিছু সাইট সিয়িং করে ঢাকা ফেরত আসবো। রবি (তৎকালীন একটেল) থেকে একটা স্কলারশিপ পাওয়ার কথা ছিল, টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার। আগেই ঠিক করেছিলাম, বুয়েটে পছন্দের সাবজেক্ট যখন পেলামই না, তখন একটেলের সুযোগটা পেলে মালেশিয়ায় উড়াল দিব, পড়বো না বুয়েটে। কিন্তু আমার সে পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলেন আমার মা। কার কাছ থেকে যেন শুনেছিলেন যে, মালয়েশিয়ার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের (নাম জানতে পারি নি) চেয়ে বুয়েটই ভালো হবে। একটেল থেকে যে অফিসার এসেছিলেন গাড়িতে করে, আমার ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য আমাকে সাথে নিয়ে যেতে, তাকে কী কী যেন লেকচার দিয়ে দিলেন আমার মা! ফলে আমার দুর্ভাগ্যের কফিনে শেষ পেরেকটাও ঠোকা হয়ে গেল! (এই মুনাফিকের দেশে পড়াশুনা না করলেই ভালো করতাম!)
বুয়েটে ভর্তির পর পাওয়া প্রথম টিউশনিটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর ফলে চলে গেল
এই টিউশনিটা চলে যাওয়াতে আমার যে তাৎক্ষণিকভাবে খুব সমস্যা হয়েছিল, তা নয়। তবে এটা দিয়েই আমার টিউশনি লাইফের কুফা শুরু হলো। আমি বেশিরভাগ সময় ‘ছাত্রী’ টিউশনি পেয়েছি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় ছাত্রীর সাথে অথবা তার গার্জেনের সাথে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমার টিউশনি চলে যেত। কখনো আমি ছেড়ে দিতাম, আবার কখনো তারা আমাকে ছেড়ে দিত। টিউশনিগুলো চলে যাওয়ার ফলে আর্থিকভাবে যে খুব সমস্যায় পড়তাম, তা না। তবে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন বিমর্ষ হয়ে থাকতাম। কেউ কি আন্দাজ করতে পারছেন, কেন?
‘চোথা’র সাথে অভ্যস্ত না হওয়া, ফলে ‘বাঁশ’ খাওয়া
বুয়েট লাইফে ‘চোথা’ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা শুরুতে আন্দাজ করতে পারি নি। আমার ধারণা ছিল, সিলেবাসের মধ্যে যে যে শিখনফল আছে, তা কভার করার জন্য আমি যেকোনো বই পড়তে পারি। কিন্তু এই আইডিয়াটা মারাত্মক ভুল ছিল, ফলে ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটস -এর প্রথম কোর্সে আমি সি পেলাম। এটা ছিল নিজের কনফিডেন্সের উপর বিশাল একটা ধাক্কা।
হলে সিট নেওয়ার মতো পঁচা সিদ্ধান্ত নেওয়া
আসলে আমি চিরকাল ঢাকাতেই পড়াশুনা করেছি এবং আমার ফ্যামিলিও সবসময় ঢাকাতেই থেকেছে। তাই হলে সিট নিয়ে ঢাকার বাইরের ছেলেপুলের সাথে মিশতে যাওয়াটা আমার জন্য বোকামি হয়েছে। আসলে তেল আর জল মিশ খায় না। তারা ছিল এক রকম মেন্টালিটির আর আমি ছিলাম অন্য রকম মেন্টালিটির। আমার উচিত ছিল কেবল প্রাক্তন আইডিয়াল বা নটর ডেমিয়ানদের সাথেই মেশা, যেমনটা অনেকেই করতো। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝতে পেরেছেন – বুয়েটে এরকম অনেককেই দেখেছি যে, তারা গুটিকয়েক ছেলেপুলের সাথে মিশতো, এর বাইরে আর কারোর দিকে ফিরেও তাকাতো না। আমারও হয়তো সেটাই করা উচিত ছিল।
বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার দিন যেটা হয়েছে সেটা ছিল আমার কপাল, কিন্তু হলে সিট নিতে যাওয়াটা ছিল আমার জীবনে করা worst মিসটেকগুলোর মধ্যে অন্যতম। হলে সিট নিয়েছিলাম পড়াশুনার উন্নতির আশায়, গুটিকয়েক ব্যক্তির পরামর্শে, কিন্তু ফল হলো উল্টো। একেই বোধ হয় বলে বুমেরাং বা ব্যাকফায়ার। উল্লেখ্য যে, হলে সিট নেয়ার ডিসিশনটা নিয়েছিলাম ২০০০ এর শেষে।