বুয়েটের কতিপয় টিচারের আচরণগত ও মনমানসিকতায় সমস্যা

আমি ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ‘৯৯ ব্যাচের। আমি প্রধানত ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের টিচারদের সংস্পর্শেই এসেছি। হল প্রভোস্ট ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট ছাড়া অন্য ডিপার্টমেন্টের টিচারদের সংস্পর্শে আসি নি বললেই চলে। আমি বুয়েটের কয়েকজন টিচারের মধ্যে আচরণগত ও মনমানসিকতায় সমস্যা দেখেছি, সেগুলো আজকে তুলে ধরবো।

ড. আমিনুল হক

আমিনুল হক আমাদের সময় পাওয়ারের কোর্সগুলো পড়াতেন। ওনার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে আর আমার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদরে (শহরে)। কিন্তু উনি এমন কিছু আচরণ করলেন যে, আমি তাঁকে ‘দেশী লোক’ পরিচয় দেয়াটা ‘উলুবনে মুক্তো ছড়ানো’ মনে করতে বাধ্য হলাম। উনি ক্লাসে যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বেশি প্যাচাল পাড়তেন। ওনার কাছে কে কে চাকুরীর উমেদারী করতে গিয়েছে, কাকে কাকে উনি চাকুরী দিয়েছেন – এসব আর কি! নিজ শ্বশুরের পরামর্শে জুপিটার পাবলিকেশন্সের চাকুরিটা ছেড়ে বড় একটা বিপদে পড়লাম, শ্বশুর তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলেন না। তখন থেকেই বুঝতে শিখলাম, বরিশালের লোকদের হম্বিতম্বিই সাড়। বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানীতে প্রাক্তন ক্লাসমেটরা বড় বড় পদে চাকুরী করছে, তারাও কোনো সাহায্যে এগিয়ে এলো না। উল্লেখ্য যে, আমি একজন ল্যাগার।

পরে আমিনুল স্যারের কাছে গেলাম। কারণ একবার উনি ক্লাসে বলেছিলেন, ‘তোমগো মইদ্দে অনেকে আমার কাছে আইসা চাকরির জন্য কানবা, আমার বাসার কার্পেট ভিজাইবা।’ বুয়েটের ছেলেরা তাঁর কাছে গিয়ে চাকুরীর জন্য কেন ‘কানবে’, সেটা তখন বুঝতে না পারলেও পরে আন্দাজ করলাম, স্যার হয়তো আমার মতো ল্যাগারদের বুঝিয়েছেন। যখন স্যারের কাছে গেলাম, তিনি তখন ডিএসডব্লিউ। তাঁর কাছে চাকুরীর কথাটা বলার পর তিনি সিজিপিএ জিজ্ঞেস করলেন। আমার সিজিপিএ ২.৯৬। শুনে বললেন, ‘তোমার সিজিপিএ ৩.৮ বা এর উপরে হলে না হয় দেখতাম। আর তোমার তো অন্য কোনো ডিগ্রীও নাই, যেমনঃ এমবিএ।’ অর্থাৎ উনি আমাকে চাকুরী দিতে বা আমার নামে সুপারিশ করতে অপারগ। মনে মনে বললাম, ‘স্যার, আমার সিজিপিএ যদি ৩.৮ এর উপরে হতো বা এমবিএ ডিগ্রী থাকতো, তাহলে কি আপনার কাছে চাকুরী চাইতে আসতাম?!’ চলে আসলাম সেখান থেকে।

এই স্যার ব্যাপক চাপাবাজি করে অভ্যস্ত। তিনি একবার তাঁর রুমে অবস্থানকালীন সময়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তো একবার ক্লাস অ্যাটেন্ড করার জন্য কুমিল্লা থেকে প্লেনে করে বুয়েটে এসেছিলাম।’ এবার আপনারা হিসাব করে বলুন, এটা চাপাবাজি কি না। উনি খুব বেশি হলে মতলব থেকে লঞ্চে করে ঢাকার সদরঘাটে এসেছিলেন, এই তো? সেটাকেই উনি বানিয়ে দিলেন ‘প্লেন’। (তখনকার দিনে প্লেন শেইপড লঞ্চ ছিল কিনা জানা নেই আমার)

স্যার যেমন নিজেকে একজন ক্লাউন হিসেবে প্রমাণ করেছেন, ঠিক তেমনি তাঁকে নিয়ে একটু মজা করতেও ইচ্ছে হয়। যেমনঃ ‘রেহনা হে তেরে দিল মে’ ছবিতে সাইফ আলী খান মাধবনকে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘কাভি নকশে মে ভি আমেরিকা দেখা হে?’ ঠিক তেমনি আমিনুল স্যারকে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘স্যার, যব আপ বুয়েটকে স্টুডেন্ট থে, তব আপ কাভি পিকচার মে ভি প্লেন দেখা হে কেয়া?’

ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের ‘নানী’ ম্যাডাম

এই মহিলার আসল নাম জানি না, সবাই তাকে ‘নানী’ বলে ডাকতো। আমাকে ল্যাগার বানানোর পিছনে তাঁর বিশাল অবদান আছে। তখন ২-২ এর কথা, ম্যাথের কোর্সের নাম ছিল ফুরিয়ার অ্যান্ড ল্যাপ্ল্যাস ট্রান্সফর্ম। ক্লাস টেস্টে আমার পেছনে বসেছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ছেলে মামুনুর রশীদ কমল, যে বর্তমানে সম্ভবত বাংলালিংকে অনেক বড় মাপের ইঞ্জিনিয়ার/অফিসার।

কমল ছিল বিশাল মাপের দুষ্ট, সে আমাকে প্রচণ্ড উত্যক্ত করতো, কী কারণে – সেটা পরে একদিন বলবো। যা হোক, ক্লাসটেস্ট যখন চলছিল, তখন কমল হঠাৎ আমার পিঠে কলম দিয়ে খোঁচা মারে। এতে আমি চমকে গিয়ে সজোরে বলে উঠি, ‘অ্যাই, খোঁচাখুঁচি করিস না!।’ তখন ম্যাডাম বুঝে-না বুঝেই খেপে গিয়ে আমাকে বললেন, ‘গেট আউট’, অথচ আসল অপরাধী যে তাকে কিছুই বললেন না। পরবর্তীতে ঐ কোর্সে আমাকে ফেল করিয়ে দিলেন তিনি। এটা তিনি অন্যায় করেছেন, এর শাস্তি তিনি ইহকাল বা পরকালে পাবেন।

ড. রেজওয়ান খান

স্যার খুব আকর্ষণীয় চেহারার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তাঁর কোনো ছাত্রের মলিন চেহারার জন্য তাঁকে ‘জাজ’ করার অধিকার রাখেন না। তখন ২০০১ সালের কথা, তিনি ছিলেন আমার অ্যাডভাইজার। ১-১ এ খারাপ রেজাল্ট করে (জিপিএ ৩.১৪) ওনার কাছে গেলাম পরবর্তী টার্মের রেজিস্ট্রেশন করতে। উনি গ্রেডশীট দেখে চমকে ওঠার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘তুমি কি আমার ছাত্র?’ আমার এস্টিমেশন মতে, উনি যতটা না পুওর গ্রেড দেখে, তার চেয়ে বেশি আমার মলিন চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। আমার চেহারা ছোটকাল থেকেই মলিন টাইপের, গরীবি মার্কা। চেহারার জন্য জীবনে আমাকে কম সাফার করতে হয় নি।

ছেলেবেলা থেকেই আমার চেহারা দেখে কে কীরকম রিঅ্যাকশন করে এটা আমার মুখস্ত। তাই স্যারের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে তাঁর মনের কথা বুঝতে আমার কোনো ভুল হয় নি। স্যার সম্ভবত একটু নাক উঁচু টাইপের, গরীবদেরকে সহ্য করতে পারেন না। আমি অবশ্য ঠিক গরীব ছিলাম না, জাস্ট আমার চেহারাটা ঐরকমই।

কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইউনাইটেডে চলে যান, সম্ভবত বুয়েটের গরীব ছেলেপুলের সাথে আর ডিল করতে চান নি (If I am not mistaken).

ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী

আমার বুয়েট লাইফের বেশিরভাগ সময় উনি আমার অ্যাডভাইজার ছিলেন। একজন ল্যাগার হিসেবে বলছি, আমার প্রতি ওনার ব্যবহার খুব একটা আন্তরিক বা শিক্ষকসুলভ মনে হয় নি। যা হোক, সেটা ওনার প্রতি আমার অভিযোগ নয়। আমার অভিযোগ হলো, ওনার অজ্ঞতার কারণে বুয়েট থেকে ফাইনাল সার্টিফিকেট পেতে আমার অনেক বিলম্ব হয়েছে (প্রায় ৭-৮ মাস)।

আমাদের সময় মেকানিক্যাল কোর্স ছিল ৪ ক্রেডিটের, কিন্তু আমি যখন রিটেক নিয়ে পাস করি তখনকার সময় সেটি ৩ ক্রেডিটের। তাই আমার টোটাল ক্রেডিট কমপ্লিট হয় ১৫৯, যেখানে গ্র্যাজুয়েশন করতে লাগে ১৫৯.৫। আর কোনো কোর্সও নেয়ার মতো ছিল না, কিন্তু স্যার খালি এক কথাই বলেছেন দীর্ঘ কয়েকটা মাস – ‘তোমার কেসটা নিয়ে আলোচনা করে রিজুলেশন হবে একাডেমিক মিটিং-এ’। অথচ মিটিং আগেই হয়েছে এরকম কেস নিয়ে এবং সেখানকার রিজুলেশন হলো – আর কোনো কোর্স যদি নেয়ার মতো না থাকে, তাহলে যতটুকু ক্রেডিট অর্জন হয়েছে, সেটা দিয়েই গ্র্যাজুয়েট ঘোষণা করা হবে। হাসিব স্যারের উচিত ছিল এসব বিষয়ে আপডেট থাকা, তাহলে আমার সময়টা ‘ওনাকে গচ্চা’ দিতে হতো না।

মেকানিক্যাল এর আশরাফুল ইসলাম

যে টিচারের কথা বলছি, তাঁর নাম আশরাফ সামথিং, সম্ভবত আশরাফুল ইসলাম। তিনি নজরুল ইসলাম হলে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট ছিলেন। আমি ঐ হলে তখন অ্যাটাচড ছিলাম। আমি ‘নাবিদ রশীদ বৃত্তি পরিষদ’ নামে একটা সংস্থা থেকে একটা মাসিক স্টাইপেন্ড পেতাম। খুব বেশি না, ২০০১ সালের সময় মাসিক ৩০০ টাকা করে। এজন্য প্রতি মাসের বৃত্তির কাগজে বুয়েট কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কারো সিগন্যাচার লাগতো। এটা করতে গিয়ে ঐ টিচার খুব খেপে গেলেন। পারলে উনি এখন আমাকে মারতে আসেন বা অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। এটা শিক্ষকসুলভ আচরণ নয়, টোটকা ব্যবসায়ীর আচরণ!

ড. শাহনেওয়াজ

উনি ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের টিচার। ওনার আচরণগত সমস্যা খুব একটা পাই নি, কেবল বিশাল রগচটা। তবে উনি ক্লাসে পুরোপুরি ইংলিশে লেকচার দিতেন। ওনার ইংলিশ উচ্চারণ ও সেনটেন্স ফর্মেশন খুব পুওর ছিল; মনে হয় না, কেউ তাঁর লেকচার খুব একটা বুঝতো। যেসব টিচাররা কিনা সঠিক ইংরেজি বলতে পারেন না, তাঁদের ইংরেজিতে লেকচার দেয়া ঠিক নয়। এ বিষয়ে আইন করতে হবে। যা হোক, ঐ সময়ে (২০০৪ সাল) শাহনেওয়াজ স্যার বোধ হয় জামাত শিবির করতেন। কারণ, সম্ভবত পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্সের কারণেই তাঁর পুরো বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই একটা জিনিস স্পষ্ট ফুটে উঠতো, আর সেটা হলো ‘দেমাগ’। (as if he was untouchable!)

মেকানিক্যাল এর ২০০২ ব্যাচের টিচার

তার নামটা মনে নেই, শুধু এতটুকু মনে আছে, সে ২০০২ ব্যাচের। আর আমি হলাম ‘৯৯ ব্যাচের, তবে একজন ল্যাগার, এই আর কি! সে খুব ভালো করেই জানতো আমি তার চেয়ে বয়সে সিনিয়র। তারপরও সে আমাকে ‘তুমি’ করে বলে, যখন কোনো একটা বিষয়ে তাকে এপ্রোচ করতে যাই। বিষয়টি আমার ভালো লাগে নি, তাকে এজন্য কখনোই ক্ষমা করবো না।

কুমিল্লার ‘ত্রি রত্ন’

এছাড়াও কয়েকজন টিচারের দিকে অঙ্গুলী উত্তোলন করতে চাই, তাঁদের সকলে অরিজিনালি কুমিল্লার বাসিন্দা। এর মধ্যে একজন হলেন ড. আব্দুল মতিন, উনি ক্লাসে কী পড়াতেন সেটা কেবল উনি জানতেন আর সামনের দিকে বসে থাকা কয়েকজন জানতো। এটা টোটালি প্যাথেটিক। কারণ টিচার কী পড়াচ্ছেন সেটা জানার অধিকার ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীরই আছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওনার মাথায় সমস্যা ছিল। তা না হলে এভাবে ক্লাস নিবেন কেন? ওনার ক্লাসসমূহের ব্যাপারে পোলাপান এতটাই হোপলেস হয়ে গিয়েছিল যে, তারা ক্লাস চলাকালীন সময়ে ক্লাসরুমের পেছন দিয়ে বের হতো আর ঢুকতো। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের কোনো ডিপার্টমেন্টের ক্লাস এভাবে চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। এজন্য মতিন স্যারকে দায়ী করবো, না অন্য কাউকে – সেটা এখন বুঝতে পারছি না।

আরেকজন হলেন ট্রিপল ই’র কামরুল ইসলাম স্যার। উনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কুমিল্লার আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলতেন। জানি না, অন্য কারো লাগতো কিনা, কিন্তু ওনার এরূপ মুখভঙ্গির কারণে ওনাকে আমার খুব ড্যাঞ্জারাস ফিল হতো। আমি মনে করি, কেবল সিজিপিএ দেখে নয়, বুয়েটে শিক্ষক নিয়োগের সময় আরো কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো – ভালো ক্লাস নিতে পারে কি না, উপস্থাপন ভঙ্গি কেমন এবং আঞ্চলিক ভাষার টান পরিহার করতে পারে কি না।

সবশেষে বলতে চাই একজন নিরীহ মানুষ নিয়ে। উনি হলেন ড. মোহাম্মদ আলী স্যার। ওনার আচরণগত বা মনমানসিকতায় কোনো সমস্যা ছিল না। তবে উনি খুবই মলিন জামাকাপড় পড়তেন। প্রাপ্তবয়ষ্ক একজন শিক্ষক যাঁর আর্থিক কোনো অসঙ্গতি নেই, তাঁর এভাবে চলাফেরা করা উচিত নয়। ড্রেসআপ ব্যাপারটা বাদেও স্যার খুবই বিমর্ষ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ করতেন এবং দুর্বল ভাষায় ক্লাস নিতেন ও ছাত্রদের সাথে কথা বলতেন। এ ধরনের আচরণ ছাত্রদের স্পিরিট নষ্ট করে। উনি ছাত্রদেরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন, যেটা অস্বাভাবিক এবং আনসাপোর্টেবল। এভাবে অ্যাড্রেস করলে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে অনুমিত হয়। এছাড়া উনি জীবনে বিয়েশাদী করেন নি, খ্রিস্টান পাদ্রীদের মতো জীবনযাপন করেছেন, এটাও অনাদর্শ ঘরানার। হোন তিনি যত বড় সায়েন্টিস্ট, একজন শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষকের মতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.