নাটক-চলচ্চিত্র-গেমসের সহিংসতা শিশুমনে গভীরভাবে দাগ কাটে

নাটক-চলচ্চিত্র-গেমসের সহিংসতা যে শিশুমনে গভীরভাবে দাগ কাটে এবং এর প্রভাব যে দীর্ঘদিন রয়ে যায় সেটা বোধ হয় প্রাপ্তবয়ষ্ক কেউ চিন্তা করেন না আমাদের দেশে। স্টার জলশায় বেশ কয়েকটি নাটকে হয় শিশুদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে (‘রাখিবন্ধন’ নাটকে) অথবা ওদেরকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে (‘পটলকুমার গানওয়ালা’ নাটকে)। বেশিরভাগ পরিবারে এসব নাটক বড়দের সাথে সাথে ছোটরাও দেখে। এসব দেখে বড়দের সম্পর্কে খুবই খারাপ মনোভাব হতে পারে শিশুদের, প্লাস ছোটকাল থেকেই ‘কুটনামি’ শিখে যেতে পারে ওরা। সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে মানুষ করতে হলে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে বাবা-মায়ের।

শুধুই কি নাটক?! গেমস আর চলচ্চিত্রেও সহিংসতার অভাব নেই; সেটা বাংলা, হিন্দী অথবা ইংরেজি – যে চলচ্চিত্রই হোক না কেন। অপেক্ষাকৃত গরীব ঘরের ছেলেরা যারা ছোটবেলা থেকেই কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করা শেখে, তারা বাংলাদেশি ছবিগুলো দেখতে সিনেমা হলে যায়। এসব সিনেমার বেশিরভাগের মধ্যেই রয়েছে অশ্লীল গালাগাল আর কারণে-অকারণে মারামারি, কাটাকাটি, খুনাখুনি। এসব ছবি দেখার কারণে গার্মেন্টসে কর্মরত কমবয়সী ছেলেরা, বাস আর টেম্পোর হেল্পাররা, বস্তির ছেলেরা কথায় কথায় মারামারিতে জড়িয়ে যায়, নেশা করে এমনকি ইভটিজিংয়ের মত কর্মকাণ্ডও করে। বড়লোকের ছেলেরাও নিরাপদ নয়, তারা যেসব গেমস খেলে আর ইংরেজি ছবি দেখে সেগুলোর বেশিরভাগই সহিংসতায় পরিপূর্ণ। প্লে-স্টেশন ফোর আর এক্স-বক্সে যে কয়টি গেম রয়েছে তার কয়টিতে মারামারি বা সহিংসতা নেই? একেবারে হাতে-গোণা কয়েকটা। আর ইংরেজি ছবিগুলোর কথা না হয় নাই বললাম।




সুস্থ ধারার ইংরেজি চলচ্চিত্র যে আসে না, তা নয়। তবে সেগুলো দেখার ব্যাপারে বাচ্চাদের আগ্রহ নিতান্ত কম। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একশনধর্মী চলচ্চিত্রই দেখতে চায়। এসব ছবি দেখতে দেখতে একসময় তারা নিজেরাও একশনে, মানে মারামারি আর গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এসব সহিংসতাপূর্ণ গেমস আর চলচ্চিত্র অনেকাংশে দায়ী। গরীবের ছেলেরাও একটাকা-দু’টাকার কয়েন দিয়ে পাড়া-মহল্লায় যেসব ভিডিও গেমস খেলে, সেগুলোও মারামারি আর ফাইটিং ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব গেমস খেলে আর ছবি দেখে বাচ্চাদের ধারণা হয় যে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মারামারির বিকল্প নেই। তাই ঢাকা শহরের অলিগলিতে তৈরি হয়েছে অমুক গ্রুপ – তমুক গ্রুপ (নাইন শ্যুটার গ্রুপ, পিচ্চি হান্নান গ্রুপ ইত্যাদি)। এসব গ্রুপের নাম শুনলে বড়দের ‘পিলে’ পর্যন্ত চমকে যায়।

তাই বড়দের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে আপনার বাচ্চাটিকে সারাদিন গেমস খেলতে আর মুভি দেখতে দিবেন না। অ্যাকশন মুভির বদলে শিক্ষণীয় অথবা এনিমেটেড মুভি দেখতে দিন, অথবা এ ধরনের মুভি দেখার জন্য বাচ্চাদেরকে মাল্টিপ্লেক্সে নিয়ে যান। আর গেমস খেলার বেলায়ও ওদেরকে কেবল ক্রিয়েটিভ গেমসগুলো খেলতে দিবেন। তাইলেই কেবল সামাজিকভাবে সুস্থ বাচ্চা আশা করতে পারেন। অন্যথায় আপনার বাচ্চাটিও ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রের ঐ প্রতিবন্ধী ছেলেটির মতো হতে পারে যার বয়স ১৮-২০ বছর হলেও গেমস খেলা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, খেলার ছলে হেলিকপ্টার চালাতে গিয়ে যে বেশ কয়েকটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ছেলেটি এতই ‘নাদান’ ছিল যে, সে জেলখানায় টিকতে পারবে না জেনে তার বাবা-মা ‘আয়না’কে জোগাড় করেন জেলখানায় তার প্রক্সি দেয়ার জন্য।

এ পর্যায়ে ছোটবেলায় নিজের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার না করে পারছি না। আমাদের সময়ে প্লে-স্টেশন টাইপের জিনিসপত্র ছিল না, আমরা দোকানে গিয়ে টাকার বিনিময়ে ভিডিও গেমস খেলতাম। সবগুলো গেমসই ধুমধারাক্কা মারামারি টাইপের ছিল, তাই ছোটবেলা থেকেই আমার মনে সবসময় সহিংসতা আর মারামারির চিন্তাভাবনা বিরাজ করতো। এতে প্রায় সময়ই আমি সহপাঠী আর সমবয়সী ছেলেদের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়তাম, পরে আবার মনেমনে ভাবতাম কেন এমন করলাম। এমনকি অনেকসময় বড়রাও মারামারি উসকে দিত।



আমার মনে আছে, আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন আমার বড় ভাই (যিনি আমার চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছরের বড়) আর তাঁর এক বন্ধু মিলে আমাকে আমার সমবয়সী ‘লিটন’ নামে একটা ছেলের সাথে মারামারিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ফলে আমিও ওর সাথে বক্সিং টাইপের মারামারি করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হলাম। কিন্তু আমি ওকে আঘাত করার আগেই লিটন আমার নাকে ঘুষি মেরে আমার নাক ফাঁটিয়ে দেয়। নাকে রক্তমাখা অবস্থায় আমি মা’র কাছে এসেও কোনো সহানুভূতি পাই নি, উল্টো তিনি আমাকেই দোষারোপ করলেন এই বলে যে, কেন মারামারি করতে গেলাম। আমার বড় ভাই-ই যে আমাকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সেটা উল্লেখ করতে ভুলে গেলাম আমি।

এবার একটা ‘নিরীহ’ নাটকের কথা বলি শুনুন। নাটকের নাম ‘সংশপ্তক’, যা ১৯৮৮ সালের দিকে বিটিভিতে প্রচারিত হতো। এই নাটকের এক পর্যায়ে ‘রমজান’ ‘লেকু’কে জন্মের কোঁপান কুঁপিয়ে পঙ্গু বানিয়ে ফেলে, ঐ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। ছেলেবেলায় বহুদিন যাবত সেই দৃশ্য আমার মনে ঘুরপাক খেত। এমনকি এই দৃশ্যের মতো করে রুটি বানানোর ‘বেলন’ দিয়ে পিটিয়েও ছিলাম একজনকে, যখন আমি ক্লাসে এইটে উঠবো এমন একটা সময়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.