জাতীয় ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক থাকায় নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের কাছে মানিকগঞ্জবাসীর আলাদা চাওয়া পাওয়া ছিল। আশা ছিল খেলাধুলা আর সৃজনশীল বিকাশে মানিকগঞ্জের কিশোর তরুণরা এগিয়ে যাবে, দেশবাসীর দৃষ্টি কাড়বে। দুর্জয় এমপি নির্বাচিত হওয়ায় সে আশা রীতিমত জেলাবাসীর প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। সবারই দৃঢ়মূল বিশ্বাস ছিল ক্রিকেটার দুর্জয়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামে গ্রামে ক্লাব কালচার ফিরে আসবে, কিশোর-তরুণরা আড্ডাবাজি, নেশা-জুয়া ছেড়ে খেলাধুলা শরীরচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। মানিকগঞ্জ থেকেও জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় গড়ে উঠবে, সুযোগ পাবে জাতীয় দলেও। নিদেনপক্ষে মানিকগঞ্জে একটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ হবে। কিন্তু সেসব প্রত্যাশায় চুন কালি মেখে এমপি দুর্জয়ের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতাতেই মানিকগঞ্জ এখন মাদক বিস্তার ও কিশোর গ্যাং অপরাধের শীর্ষ জেলায় পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের ব্যাপারটিও নানারকম জটিলতা বাঁধিয়ে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। এমপি দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকাকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যের উর্বর ভূমি। সেখানকার তারুণ্যকে আটকে ফেলা হয়েছে নেশার ফাঁদে।
এমপি দুর্জয়ের ডান হাত খ্যাত জেলা পরিষদ সদস্য, যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আবুল বাশার এবং বাম হাত হিসেবে পরিচিত মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, জেলা যুবলীগের আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজা’র নেতৃত্বেই জেলার মাদক বাজার ও কিশোর অপরাধীদের গ্যাং গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। শীর্ষ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও মাদকসহ কিশোর গ্যাং বিস্তারের অপকর্মে এ দু’জনকে দায়ী করা হলেও তাদের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে এমপি দুর্জয়ের নাম।শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক পৃথক জরিপ ও অনুসন্ধানে মানিকগঞ্জে মাদক বিস্তার ও কিশোর গ্যাংগুলোর অপরাধ তৎপরতাকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মানিকগঞ্জ জেলার ১৪২ জনের বিরুদ্ধে মাদকের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনসহ মন্ত্রনালয়গুলোর জরিপ রিপোর্ট ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মাদক বাণিজ্য পরিচালনাসহ সন্ত্রাসী লালন পালনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী হিসেবে জেলার ১৪ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির যে তালিকা রয়েছে তারমধ্যে ২ নং তালিকায় আছে আব্দুর রাজ্জাক রাজা এবং ৩ নং তালিকায় আবুল বাশারের নাম রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে এই চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে দুর্জয়ের কিসের ঘনিষ্ঠতা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
মানিকগঞ্জে এমপির পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত অনেক নেতা-কর্মীই সেখানে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। কিশোর-তরুণদের সমন্বিত অপরাধী গ্যাংও গড়ে উঠেছে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায়। সংঘবদ্ধ এ মাদক চক্রের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আবুল বাশার। তিনি দুর্জয় এমপি’র ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার বিশেষ আনুকূল্যেই বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্যও হয়েছেন আবুল বাশার। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে ধাপে ধাপে যুবলীগের নেতৃত্ব পাওয়া সাংগঠনিক দক্ষতায় জনপ্রিয় নেতাদের হটিয়ে দুর্জয় রাতারাতি রাজা-বাশারদের নেতা বানান, তাদের হাতেই তুলে দেন জেলা যুবলীগের কর্তৃত্ব। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে নেতৃত্ব পাওয়া রাজা ও বাশারকে দুই হাতে অর্থ কামিয়ে আনার কর্মকাণ্ডেই নিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে জেলার টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জায়গা জমির দখলবাজি থেকে শুরু করে এলাকা পর্যায়ে সন্ত্রাস সৃষ্টিসহ দেদার মাদক বাণিজ্য।
দেখতে দেখতেই মাত্র ২/৩ বছরেই মানিকগঞ্জ হয়ে উঠেছে নেশার সাম্রাজ্য। স্কুল পড়ুয়াদের হাতেও উঠে এসেছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা। নিভৃত গ্রামাঞ্চলেও এখন কয়েক ডজন ইয়াবাসেবীকে নেশার আড্ডায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। মাদক, নেশা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘিরে পারিবারিক পর্যায়েও ঝগড়াঝাটি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকছে।
অদৃশ্য ক্ষমতার বলে বলিয়ান আবুল বাশারের তত্বাবধানেই মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ ছাত্রলীগের নেতা নাদিম হোসেন, তানভির ফয়সাল, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আসাদুজ্জমান ও পৌর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অলিদ আহমেদ, ছাত্রলীগ কর্মী সৌরভ, শাকিল, যুবলীগের পরিচয় দেওয়া বিকাশ, লিটন এলাকায় পাইকারী হারে ইয়াবা ব্যবসা করে চলছে। মাদক ডিলার হিসেবে পরিচিত এসব নেতা জেলার সর্বত্র ইয়াবার সরবরাহ দিয়ে থাকেন বলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। এদের মধ্যে বিকাশ ও লিটনকে পুলিশ আটক করলেও বাকিরা আছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাদক ডিলারদের সবাই জেলা যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আবুল বাশারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মানিকগঞ্জে অবস্থানকালে তারাই এমপি দুর্জয়কে সার্বক্ষণিক ঘিরে বিচরণ করে থাকে।
এদিকে এমপি দুর্জয়ের আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেলা যুবলীগের আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজার তত্ত্বাবধানে মাদকের পাশাপাশি জেলা জুড়ে গড়ে উঠেছে কিশোর-তরুণদের সমন্বিত অপরাধী গ্যাং। বিভিন্ন স্কুল ও মহল্লা পর্যায়ে গড়ে তোলা এসব অপরাধী গ্যাং খুবই ভয়ঙ্কর হিসেবে চিহ্নিত। গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক এ ছত্রছায়ায় মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১১টি কিশোর-তরুণ গ্যাং গড়ে ওঠার খবর পাওয়া গেছে। এসব বখাটেদের নামে কয়েকটি করে অপরাধমূলক মামলাও হয়েছে। কেউ কেউ দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর এক গোপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সংরক্ষিত গ্রুপ করে এগুলোর সদস্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে একাধিক গ্রুপের সমন্বয়ে একটি গ্যাং গড়ে উঠে। এসব গ্যাং সদস্যরা বরাবরই দলীয় নেতাদের ও সংসদ সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে অপরাধ করছে।
অল্পবয়সেই মাদকের নেশায় জড়িয়ে অনেক কিশোর লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ ধরনের গ্রুপে জড়িয়ে পড়ছে। প্রেম ও প্রতিহিংসাজনিত কারণে এমনকি পাড়া-মহল্লায় পেশিশক্তির আনুকূল্য পেতেও অনেক কিশোর এসব গ্রুপে জড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সন্তানদের প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব কিশোর অপরাধীদের গ্যাং গড়ে উঠছে দুর্জয় এমপির ডান হাত খ্যাত জেলা যুবলীগের আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজার নেতৃত্বে। মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরও তিনি। তার সহযোগিতা জেলার সর্বত্র গড়ে তোলা কিশোর-তরুণদের সমন্বিত অপরাধী গ্রুপগুলো নানারকম বখাটেপনা করেই ক্ষ্যান্ত থাকে না, নেতাদের নির্দেশনা মোতাবেক নানা রাজনৈতিক আক্রোশ মেটানোরও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তারা। বিশেষ করে ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলায় এমপি দুর্জয় বিরোধী নেতা কর্মীদের ন্যাক্কারজনকভাবে নাজেহাল করতেও এ অপরাধী গ্যাং ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অবাধ্য নেতা কর্মীদের বাড়িঘরে ঝামেলা বাঁধিয়ে, তাদের স্বজন পরিজন ছাত্রীদের ঘিরে নানা বখাটেপনা চালিয়ে শায়েস্তা (!) করার জঘন্য পথ বেছে নেওয়া হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, জেলায় বাশার ও রাজা নামের যে দুই যুবলীগ নেতার নামে মাদক বাণিজ্যসহ সন্ত্রাসী লালন পালন সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের সঙ্গেই এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের মাখামাখি। দুর্জয়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত বিষয়াদি পর্যন্ত তারাই দেখভাল করে থাকে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জুন, ২০২০