করোনাকাল, মানে গত প্রায় পাঁচ মাস আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে। পুরোনো সব ধারণাকে নতুন করে সাজানোর একটা সুযোগও দিয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি প্রায় সব বিষয়ে নতুন নতুন ধারণারও জন্ম দিয়েছে। ভবিষ্যতে যে এগুলোই আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম।
আমরা সবচেয়ে কম যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিই সেটা হলো সঞ্চয়। ভাবখানা এমন, অর্থই তো নেই, সঞ্চয় করবটা কী? কিন্তু এই করোনাকালে আমরা দেখেছি, প্রায় সবাই ভাবিত ছিলেন এক মাস বা দুই মাস যদি কাজকর্ম বন্ধ থাকে, তাহলে যেটুকুও জমানো আছে তাতে হাত দিতে হবে। আর যদি করোনার ডামাডোলে চাকরিটাই চলে যায় কিংবা ব্যবসাটাই আর নতুন করে চালু করা সম্ভব না হয় তাহলে কী হবে, সে ভাবনা ভেবে অনেকেই বিষণ্ন দিন কাটিয়েছেন এবং কাটাচ্ছেন। তার চেয়েও বড় কথা, সামনের দিনগুলো হবে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কঠিন।
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ মৃত্যু। তারপরই সম্ভবত বেশি উচ্চারিত শব্দ অর্থনীতি। অনেক দেশ এই অর্থনীতিকে বাঁচাতেই মৃত্যু এবং সংক্রমণের সব চিন্তাকে পাশে সরিয়ে রেখে লকডাউনও শিথিল করেছে। অনেক দেশ তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে সীমান্ত খুলে দিয়েছে, পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে। একটি দেশের এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ব্যক্তি হিসেবে আপনার অবস্থাটা কী? ভাবুন, নতুন করে ভাবুন।
কেন সঞ্চয় করবেন
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আগামী দুই বছর বারবার করোনার অভিঘাত নেমে আসতে পারে আমাদের ওপর। কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, সেটা কেউই এখনো নির্ধারণ করে উঠতে পারেনি। এমনও ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে লকডাউন হবে আরও কড়াকড়ি। নইলে মৃত্যুর হার কমানো যাবে না। ফলে দীর্ঘদিন আটকে থাকতে হতে পারে ঘরে। আর সে রকম হলে এবারের অভিজ্ঞতায় বোঝাই যাচ্ছে, চাকরি ও ব্যবসার হাল তখন আরও খারাপ হবে। নতুন করে ব্যবসা শুরু করা কিংবা হারানো চাকরি খুঁজে পাওয়া হবে কঠিন।
ছিন্নমূল মানুষ যেমন এবারের লকডাউনে ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়েছিল মধ্যবিত্ত ও ছোট ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষও। অন্তত সংবাদমাধ্যমের খবরে এবং ত্রাণ তৎপরতার সংবাদে আমরা তেমনটাই দেখেছি। করোনা সংক্রমণে মৃত্যুবরণের হিসাব হয়তো থাকবে, কিন্তু পরিবার বাঁচানোর দুশ্চিন্তায় মৃত্যুবরণ করা মানুষের হিসাব কে রেখেছে?
এবারের লকডাউন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, একজন রিকশাচালক কিংবা ফুটপাতের চটপটিওয়ালা অথবা ভিক্ষুকের জীবনযাপনের সঙ্গে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের জীবনের পার্থক্য সামান্যই। অর্থনৈতিক প্রবাহ যদি নিরবচ্ছিন্ন না থাকে, তাহলে এক সপ্তাহের লকডাউনে যেমন সেই সব মানুষ না খেয়ে থাকবে, তেমনি দুই মাসের লকডাউনে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীরাও পথে বসে যেতে পারেন।
জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকবে সামনের দিনগুলোতে। মাঠপর্যায়ের সংবাদ হলো, ভরা বোরো মৌসুমেও ধানের দাম গতবারের তুলনায় বেড়েছে। ধানের দাম সামনে আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন চাষিরা। অভিজ্ঞজনেরা জানাচ্ছেন, আমন মৌসুমেও এবার ধানের দাম বাড়বে। অর্থাৎ, পুরো বছরই ধানের দাম বাড়তি থাকবে। ধানের দাম বাড়লে চালের দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। লকডাউনের কারণে ঈদসহ বিভিন্ন জমজমাট সময়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করতে পারেনি, বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট, ফ্যাশন হাউস, তারা কিন্তু ক্ষতি পোষাতে কিছু হলেও তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। সুতরাং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বিলাস দ্রব্য, সবখানেই পণ্যের দাম দ্বিগুণ না হলেও যে বাড়বে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কাজেই সঞ্চয়ের কথা ভাবুন, যাতে নতুন পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে জীবনধারণের দুশ্চিন্তায় থাকতে না হয়।
কীভাবে সঞ্চয় করবেন
গত পাঁচ মাসের কোন শিক্ষাটা নিয়েছেন আপনি? স্বাস্থ্যসচেতনতা নাকি অনাড়ম্বর জীবন? সংক্রমণ ঠেকাতে, সুস্থ থাকতে স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রয়োজন আছে অতি অবশ্যই। কিন্তু খেয়াল করেছেন কী, এই করোনাকালে আপনি অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন নিজের অগোচরেই। অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আপনার জীবন থেকে নিজের মতো করে বিদায় নিয়েছে।
খেয়াল করে দেখুন, আপনার খাবারের টেবিল হয়েছে আগের চেয়ে স্বাস্থ্যকর এবং সেটা কম টাকায়। বাইরের খাবার না খেয়েও আপনি দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছেন গৃহবন্দী সময়। লকডাউনের পুরো সময় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ছাড়া বিলাস দ্রব্য কিংবা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছেন খুবই কম। যানবাহন কম থাকার কারণে জরুরি প্রয়োজনে কাছাকাছির প্রায় সব জায়গায় গেছেন হেঁটে। তাতে আপনার যাতায়াতের খরচ কমেছে আপনার ধারণার চাইতেও বেশি। আপনার অনেক বাজে অভ্যাসে লাগাম পরেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, যা আপনি টেরও পাননি। তাতে খরচ বেঁচেছে বই বাড়েনি।
নিজের পরিবারকে মাথায় রেখে এবার এই সবকিছু হিসাব করতে বসুন। দেখবেন আপনার যে অর্থ বেঁচে গেছে, সেটা আপনার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হিসাব করলে আপনার হার্টবিট বেড়েও যেতে পারে। এই সু–অভ্যাসগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগান এবং দেখুন আপনি যে টাকা প্রতি মাসে উপার্জন করতেন, সেখান থেকেই বেশ বড় একটা অংশ আপনার সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পারছেন। মনে রাখবেন, সঞ্চয় মানে শুধু ব্যাংকে টাকা জমানোই নয়; সুনির্দিষ্টভাবে, সুনিয়ন্ত্রিতভাবে খরচ করা কিংবা নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনও বড় সঞ্চয়।
পৃথিবীর বড় ধনীদের অন্যতম ওয়ারেন বাফেটের নামে একটি কথা চালু আছে। কথাটি হলো, সব ডিম এক ঝুরিতে রাখবেন না। কোনো কারণে আপনার সেই ঝুরি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সব ডিম একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ব্যাংকে অর্থ রাখার প্রবণতা ভালো, কিন্তু তা না করেও আপনি সঞ্চয় করতে পারেন অপ্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে। বরং দুটি অভ্যাসই গড়ে তুলুন, তাতে আপনার সঞ্চয়ের জায়গা বাড়বে।
ভবিষ্যতের সঞ্চয়
১. করোনাকালের লকডাউনের সব সু–অভ্যাস বজায় রাখুন সামনের দিনগুলোতেও।
২. ভবিষ্যতে অনেক ছোট ছোট বাণিজ্যিক উদ্যোগ গড়ে উঠবে খুব অল্প পুঁজিকে কেন্দ্র করে। সম্ভব হলে সেগুলোতে লগ্নি করুন। কিংবা নিজেরাই শুরু করুন কয়েকজন মিলে। কিন্তু অনেক লাভ হবে ভেবে কোথাও অর্থ লগ্নি করবেন না।
৩. ব্যাংকগুলো সামনে সঞ্চয়ের জন্য অনেক স্কিম ঘোষণা করবে। সেগুলো বিষয়ে খোঁজখবর রাখুন।
৪. পরিবারের সবাইকে উৎসাহিত করুন হিসাবের চেয়ে কীভাবে কম খরচ করা যায়, সেটা ভেবে বের করতে।
৫. জীবনকে সহজ রাখা যায় কীভাবে, সেটা নিয়ে ভাবুন।
সূত্রঃ প্রথম আলো