শিক্ষাবর্ষ বাড়তে পারে মার্চ পর্যন্ত, কমবে সিলেবাস
করোনার কারণে বর্তমান শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। পাশাপাশি শ্রেণি ঘণ্টার সঙ্গে সমন্বয় করে কমানো হতে পারে মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির সিলেবাস। এমন পদক্ষেপের কারণে আগামী বছরে ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে আনা হতে পারে। যেসব পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি সেগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় কি না তাও চিন্তাভাবনা চলছে। তবে সিলেবাস কমানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে কোনো আপোষ করা হবে না।
শনিবার এডুকেশন রিপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব) আয়োজিত অনলাইন সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘করোনাকালে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এ ভার্চুয়াল সেমিনারে সভাপতিত্ব সংগঠনের সভাপতি মুসতাক আহমদ। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম।
অনুষ্ঠানে স্বাগত জানান ইরাব সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক। সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাব্বির নেওয়াজের সঞ্চালনায় এতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ইরাব কোষাধ্যক্ষ শরিফুল আলম সুমন। আলোচনায় অংশ নেন ইরাব যুগ্ম সম্পাদক ফারুক হোসাইন, সাংগঠনিক সম্পাদক এম এম জসিম, দফতর সম্পাদক এম এইচ রবিন, ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার মহিউদ্দিন জুয়েল, ঢাকা টাইমসের স্টাফ রিপোর্টার তানিয়া আক্তার।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমান সংকট পুষিয়ে নিতে চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হবে কি না, না ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে তা ভাবনাচিন্তা চলছে। শিক্ষাবর্ষ বাড়ানো হলে আগামী বছরে ঐচ্ছিক ছুটি কমানোর প্রয়োজন হবে। একটি শিক্ষাবর্ষে আমরা ১৪০-১৪২ দিন পড়িয়ে থাকি। বাকিটা ছুটি থাকে। তাই এ বছর শিক্ষাবর্ষ বাড়াতে হলে আগামী বছরের ছুটি কমিয়ে হলেও তা করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের দিকটিতে আপস করা হবে না।
তিনি বলেন, এবারের এইচএসসি পরীক্ষার অল্প সময়ে নেয়া যায় কিনা সে ভাবনাচিন্তা আছে । তবে সিলেবাস কমানোর যৌক্তিকতা নেই। কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সিলেবাস সম্পন্ন করেছে। করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে আসার ১৫ দিন পর এই পরীক্ষা নেয়া হবে।
ডা. দীপু মনি বলেন, বড় একটা সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি দেয়া নিয়ে। ফি না পেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষকদের কী করে বেতন দেবে? আর শিক্ষকরা তো অধিকাংশই বেতনের ওপর নির্ভরশীল। কেউ কেউ টিউশনি করাতেন, এখন তো সব বন্ধ। আসলে উভয়পক্ষকে ছাড় দিয়ে এবং মানবিক আচরণ করে এই দুর্যোগের সময়টা আমাদের পার করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এক রকম নয়। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজেদের কিছুটা হলেও আগামী ক’মাস চলার মতো, কোনোভাবে চলার মতো সামর্থ্য আছে তাদেরকে অনুরোধ করব ফি’কে কিস্তিতে হোক বা কিছুদিন বাদ দিয়ে পরে নেয়া হোক, সেটি করতে পারেন ভালো। না হলেও দেখেন কতটা ছাড় দেয়া যায়, সেটা চেষ্টা করবেন। এই সময়ে স্কুল বন্ধ আছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে সে কারণেও কিছু খরচ কম। সেই খরচটুকু বাদ দিয়ে, বাকি যে খরচ, শিক্ষকদের বেতন ইত্যাদি।
তিনি বলেন, অভিভাবকদেরও বলব- আপনাদেরও কিছু ছাড় দিতে হবে, কারণ কিছু না কিছু বেতন তো দিতে হবে। আপনার সন্তান পড়াশোনা করছে, এখন প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে মানে তো সেই বেতন বন্ধ করে দেয়া যায় না। আপনার সন্তানের ফি যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে দেয়া উচিত। আর যদি আপনার সামর্থ্য না থাকে সেক্ষত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারাও যদি কিছুটা ছাড় দিতে পারে। কিছুটা কিস্তিতে নিতে পারে, যতদূর সম্ভব উভয় পক্ষকেই আসলে মানবিক আচরণ করতে হবে। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এরপর আপনার সন্তানটিকে আপনি কোথায় ভর্তি করাবেন? সেটি সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের দুশ্চিন্তা নিশ্চয়ই।
সংসদ টিভির চলমান ক্লাসগুলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের উপযোগী করে তোলার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, টিভি ক্লাসগুলো মোবাইল ফোনসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। তবে এখনো ১০ ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে সংসদ টিভির ক্লাসগুলো পৌঁছায়নি। কিন্তু এই দশভাগকে পেছনে ফেলে আমরা সামনে এগিয়ে যাব না। তাই ইতিমধ্যেই আমরা টোল ফ্রি মোবাইল সুবিধা দেব যা খুবই দ্রুত সেটা চালু করতে যাচ্ছি যার মাধ্যমে সেই ১০ ভাগ শিক্ষার্থীও শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে পাঠের সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বাজেটে প্রস্তাবনা থাকলেও শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রকে এর বাইরে রেখে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে কিভাবে ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া যায় সেটা নিয়েও আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এছাড়াও কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর বিষয়ে আমাদের কাজ চলছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের তথ্য সেবা কেন্দ্র ও ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রগুলোকে শিক্ষার জন্য ব্যবহার করা পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্যসেবা কেন্দ্র ও ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীরা সেখান থেকেও শিক্ষা সেবা নিতে পারে।’
তবে যেসব জায়গায় এই সুবিধাগুলো নেই সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষাদানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হতে পারে বলে জানান তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে এই ডিজিটাল সেবা পৌঁছাতে পারবে না আমরা চাইব শিক্ষকরা কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে পাঠদান করতে পারে সেই বিষয়ে আমরা ভাবছি।’
তিনি আরও বলেন, ’ট্রেডিশনাল প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসরুম বা ল্যাবরেটরি কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়াই শিক্ষার্থীরা শিখতে পারবে না প্রযুক্তির এই যুগে এটা বলা ঠিক হবে না। যেহেতু ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরির সুবিধাটি রয়েছে, আমরা চেষ্টা করবো সে সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য।’
শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি ব্যবহারের গতি বেড়েছে। তবে করোনা পরবর্তী সময়ের জন্য আমাদের বেশকিছু পরিকল্পনা রয়েছে। আগে এক বেঞ্চে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী বসতো। সেটা হয়তো আপাতত সম্ভব হবে না, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। বছরে শুধু ১০০ দিনের বেশি সরকারি ছুটিই থাকে, তা রিভিউ করা হবে। এজন শিক্ষার্থীর পরবর্তী ক্লাসে উন্নীতের জন্য যা পড়ানো দরকার বা যেসব পরীক্ষাগুলো প্রয়োজন সেগুলো নেওয়া হবে।’
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, একদিকে ইন্টারনেটের ওপর সবকিছু নির্ভরশীল হচ্ছে অন্যদিকে এর ব্যবহার বাড়ালে সব প্রস্তুতি বিফলে যাবে। ইন্টারনেট মানুষের হাতের নাগালে রাখতে হবে এজন্য সরকারকে এ খাতে প্রণোদনা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষার একটি প্রজন্ম হারিয়ে গেলে কয়েক প্রজন্ম হারিয়ে গেল তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, এ বছরের জন্য পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা যেতে পারে। আলোচনা করে পরে তা চালু করা যায়।
ড. ফারহানা খানম বলেন, স্কুলের টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের দাবি আছে। কারো ক্ষেত্রে হয়তো এটা সঠিক। কিন্তু ফি না দিলে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি অনলাইন ক্লাস, সিলেবাস হ্রাস, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিভাবকদের উৎকণ্ঠার দিকগুলো তুলে ধরেন।
সূত্রঃ যুগান্তর, ২৭ জুন, ২০২০