ইউসুফ (আঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইউসুফ (আঃ) কেনান প্রদেশে (যেটা বর্তমানে ইসরাইল) জন্মগ্রহণ করেন হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর এগারোতম সন্তান হিসেবে। তিনি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সুদর্শন ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন, সেজন্য তাঁর পিতা তাঁকে অত্যন্ত আদর করতেন; একারণে তিনি তাঁর বড় (সৎ) ভাইদের ‘চোখের বালি’তে পরিণত হলেন। পিতা-পুত্রের এই মহব্বত সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে তাঁর ভাইয়েরা মিলে তাঁকে এক গভীর গর্তে ফেলে দেন। সেখান থেকে যারা তাঁকে উদ্ধার করে, তারা তাঁকে আটকে মিশরে নিয়ে যায় এবং সেখানকার এক ‘ক্রীতদাসের হাটে’ তাঁকে বিক্রি করে দেয়। তাঁকে ক্রয় করেন ‘পতিফার’ যিনি ফারাও’র প্রধান স্থপতি ছিলেন, পতিফারের স্ত্রীর নাম জুলায়খা। সুদর্শন ক্রীতদাস ইউসুফের প্রতি ঐ মহিলার কুনজর পড়ে, তিনি ইউসুফকে একান্ত করে পেতে চাইলেন। কিন্তু ইউসুফ তা অস্বীকার করায় প্রতিশোধ হিসেবে তাঁকে জেলে পুরে দেন। সেখানে বহুবছর ইউসুফ জেলের ঘানি টানলেন, এক পর্যায়ে চরম অধৈর্য্য হয়ে গেলেও মনে মনে ভাবলেন, একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন কেন তিনি তাঁকে এই শাস্তি দিচ্ছেন। ইউসুফ (আঃ)-এর একটি ভালো গুণ ছিল এই যে, তিনি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে পারতেন। একবার ফারাও এক আজব স্বপ্ন দেখতে লাগলেন বেশ কয়েকদিন ধরে। তিনি তাঁর সভাসদ পতিফার-এর মাধ্যমে ইউসুফের স্বপ্নব্যাখ্যাদানের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা জানতে পারলেন। তিনি ইউসুফকে জেল থেকে ডেকে এনে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। সব শুনে ইউসুফ জানালেন যে, তখন থেকে সাত বছর পরে মিশরে এক ভয়াবহ খরা হবে। খোদা ফারাওকে ঐ সম্ভাব্য দুর্যোগের কথাই স্বপ্নের মাধ্যমে জানাচ্ছেন, যাতে ফারাও মিশরের অধিবাসীদেরকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ফারাও পতিফারকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি ইউসুফকে কতটা বিশ্বাস করেন। পতিফার আগে থেকেই তাঁর স্ত্রী জুলায়খার দুশ্চরিত্রের কথা জানতেন। তাই তিনি ফারাওকে জানালেন যে, তিনি ইউসুফকে এতটা বিশ্বাস করেন যে, তাঁর কথার উপর ভিত্তি করে জীবনও বাজি রাখতে পারেন। তাঁর কথায় খুশি হয়ে ফারাও ইউসুফকে অনির্দিষ্টকালের জন্য মিশরের খাদ্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। বলতে গেলে, ফারাও’র পর তিনিই হলেন মিশরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।


সাত বছর পর সত্যসত্যই মিশরে এবং এর আশেপাশের দেশগুলোতে (কানানসহ) ভয়াবহ খরা ও দুর্ভিক্ষ শুরু হলো। তখন ইউসুফ (আঃ) -এর সেই সৎ ভাইয়েরা খাদ্যের অন্বেষণে মিশর পর্যন্ত এসে হাজির হলো, তারা জানতো না যে, তাদেরই ছোটভাই ইউসুফ তখন মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তবে তারা খাদ্য ভিক্ষা করতে এসেও নম্রতা-ভদ্রতার আশ্রয় নিলো না। তারা ওদ্ধত্যের সাথে স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করতে চাইলো। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘স্বর্ণমুদ্রা নাও, খাদ্য দাও।’ ব্যাপারটা আসলে ততটা সহজ ছিল না ঐ পরিস্থিতিতে, কারণ প্রচণ্ড খরা ও দুর্ভিক্ষের দরুণ খাদ্য তখন স্বর্ণের চেয়েও দামি বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। তারপরও ইউসুফ (আঃ) তাদেরকে চিনতে পেরে তাদেরকে খাদ্য দিতে রাজি হলেন, এক শর্তেঃ তাদের সবচেয়ে ছোটভাই বনিআমিনকে সাথে নিয়ে আসতে হবে (বনিআমিন ছিলেন ইউসুফের মাতার গর্ভে জন্ম নেয়া তাঁর আপন ছোট ভাই এবং ইয়াকুব (অাঃ)-এর বারতম সন্তান)। বড় ভাইয়েরা সেটাতে অসম্মতি জানালো, তারা বললো যে, তাদের পিতা তাদেরকে বিশ্বাস করেন না। ইউসুফ এর কারণ জানতে চাইলেন। তখন তারা বললো যে, বহু বছর আগে তাদের সাথে তাদের ছোটভাই ইউসুফকে যেতে দিয়েছিলেন পিতা, মেষপালকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে। কিন্তু তাদের অবহেলা এবং ভুলের কারণে ইউসুফকে নেকড়ের দল খেয়ে ফেলেছিল, এরপর থেকে তাদের পিতা সর্বদাই বিমর্ষ হয়ে থাকেন। এই কারণে ছোট সন্তান বনিআমিনকে তাদের সাথে কখনোই যেতে দিবেন না তাদের পিতা। ইউসুফ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারা একগাদা মিথ্যে বানিয়ে পিতাকে বলেছে। তখন তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেনঃ ‘খাদ্য নিতে হলে ছোটভাইটিকে আনতেই হবে’। তখন তারা ভগ্ন হৃদয়ে প্রস্থান করে পুরো ব্যাপারটা পিতাকে খুলে বলে। অভুক্ত থেকে মারা যাওয়ার চেয়ে ছোটসন্তান বনিআমিনকে তাদের সাথে যেতে দিতে রাজি হলেন ইয়াকুব। এবার তারা এগারো ভাই একসাথে এলে ইউসুফ তাদেরকে প্রথমে খুব খানাপিনা করান ও আদর-যত্ন করেন, কিন্তু পরবর্তীতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যে চুরির অভিযোগ এনে ছোটভাই বনিআমিনকে বন্দী করতে চাইলেন। এতে বড় ভাইয়েরা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, বনিআমিনকে ছাড়া ফিরে গেলে তাদের পিতা পুত্রের শোকে এবার নির্ঘাৎ মৃত্যুবরণ করবেন। তাই তারা প্রত্যেকে ইউসুফের পায়ে পড়লো এই বলে যে, ‘হুজুর, আমার ছোট ভাইটির বদলে আপনি আমাকে বন্দী করেন।’ তখন ইউসুফ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন? সৎ ভাইয়ের পাপের শাস্তি তোমরা নিতে চাচ্ছ কেন?’ তখন তারা বাধ্য হয়ে ইউসুফের কাছে পুরনো পাপের কথা স্বীকার করে; তারা জানায় যে, তাদের ছোট ভাই ইউসুফকে নেকড়ে দল খেয়ে ফেলে নি, বরং তারা নিজেরাই গর্তে ফেলে দিয়েছিল। অপরাধ স্বীকার করায় তাদের প্রতি দয়া হয় ইউসুফ (আঃ)-এর, তিনি নিজেকে তাদের হারিয়ে যাওয়া ভাই হিসেবে পরিচয় দিলেন, এতে তারা যারপরনাই আবেগআপ্লুত ও খুশি হয়ে তাদের পুরনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইলো, ইউসুফ তাদেরকে ক্ষমা করলেন। তিনি আরো বললেন, ‘যাও, তোমরা গিয়ে আমাদের পিতাকেও নিয়ে এসো।’ তখন তারা তাই করলো। বৃদ্ধ ইয়াকুব তাঁর হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে যারপরনাই খুশি হলেন এবং ভাবলেন যে, ‘যাক, এবার শান্তিতে মরতে পারবো।’ তখন থেকে তাঁরা সকলে মিশরেই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধরই বনী-ইসরাইল নামে পরিচিত ছিল, যারা ঘটনাক্রমে পরবর্তীতে ফারাওদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এদেরকে উদ্ধার করার জন্যই খোদা মুসা (আঃ)-কে পাঠান যিনি নিজেও বনী-ইসরাইলের বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং অত্যাচারী ফারাও’র হাত থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে নীলনদ পার হয়ে তাদের এককালের স্বদেশভূমি কানানে (বর্তমানের ইসরাইলে) ফিরে আসেন।



Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.