আব্রাহাম লিঙ্কন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের মতো ধনী ছিলেন না, তিনি বেশ কিছু প্রেসিডেন্টের মতো সুদর্শনও ছিলেন না। তারপরও তাঁকেই আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর একটি প্রধান কারণ হলো, তিনি তাঁর শাসনামলে আমেরিকাকে বিভক্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আর একটি কারণ হলোঃ তিনি দাসপ্রথার কলঙ্ক থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করেছেন।
প্রথমে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সামান্য কিছু বলা যাক। তিনি একটি সাধারণ মানের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অল্পবয়সে তাঁর মা মারা যায় এবং তাঁর বাবা তাঁকে প্রায়ই প্রহার করতেন। এজন্য প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পরপরই তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান এবং পিতার সাথে আর যোগাযোগ রাখেন নি। তিনি পেশায় একজন আইন ব্যবসায়ী বা উকিল ছিলেন। দাসপ্রথার ব্যাপারটা ছোটকাল থেকেই তাঁর কাছে খটকা লাগতো। কিন্তু এ ব্যাপারে মুখ খোলার কোনো জো ছিল না, কারণ দাসপ্রথাকে আমেরিকার সকল স্তরের লোকজন স্বাভাবিক চোখেই দেখতো। কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় এই সহজ-সরল সাধাসিধে ব্যক্তিটিই আমেরিকা বা ইউএসএ’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হলেন। তাঁর শাসন আমলে আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়। দক্ষিণের কিছু স্টেট উত্তরের স্টেটগুলোর বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে লিঙ্কন যেহেতু রাজধানী ওয়াশিংটনে বাস করতেন, তাই তিনি উত্তরের স্টেটগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করতেন।
তিনি জানতেন, এ যুদ্ধে হেরে গেলে আমেরিকা চিরতরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই দেশটাকে অবিভক্ত রাখার জন্য তিনি সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি এসময় দু’-একজন জেনারেল তাঁকে অপমান করলেও সেটা তিনি মুখ বুঝে সহ্য করেন। বলে রাখা ভালো যে, গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো এই যে, লিঙ্কনের সরকার দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছিলো, যেটা দক্ষিণের বেশ কিছু স্টেট ভালো চোখে দেখে নি। এক পর্যায়ে স্বপক্ষের বেশকিছু ক্ষমতাধর লোকজন, যেমন একজন জেনারেল তাঁর বিরোধিতা ও অসহযোগিতা শুরু করলে তিনি যুদ্ধে জেতার জন্য সদ্যমুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ দাসদেরকে ব্যবহার করেন। মূলত এই কৃষ্ণাঙ্গদের কল্যাণেই তিনি যুদ্ধে বিজয়ী হন।
প্রথম দফায় চার বছর শাসন শেষে তিনি পুনরায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবার তিনি কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ভোটের অধিকার দিতে চাইলেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া শুরু করলেন। কিন্তু এ বিষয়টি কিছু বর্ণবাদী লোক মেনে নিতে পারে নি। তাদেরই একজন লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে; সারা আমেরিকার লোকজন কান্নায় ভেঙ্গে পরে, যা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। এখনো কথায় কথায় আমেরিকার লোকজন লিঙ্কনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল ইলিনয় স্টেটে।
লিঙ্কন যদি আমেরিকার বিভক্তি ঠেকাতে না পারতেন, তাহলে বিশ্বভূগোলের চেহারা ভিন্ন হতো তথা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। মূলতঃ তিনি ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক, প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েও তিনি যতটা সম্ভব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন, আপামর জনগণকে ভালোবাসতেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতেন না। এ সকল কারণেই তাঁকে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট মানা হয়। তিনি এতটাই সাধারণ মানসিকতার ছিলেন যে, বেশি পুলিশ প্রটেকশন ব্যবহার করতে চাইতেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘কেউ যদি আমাকে মারতে চায়, তাহলে কোনো মাপের পুলিশ প্রটেকশন দিয়েই কোনো কাজ হবে না।’