আমার একমাত্র সন্তান ফাইয়াজ, তার বয়স ৪ বছর। সে একটু অটিস্টিক টাইপের, তবে শ্যামলী শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ডাক্তারদের মতে, ভালো মতোই অটিস্টিক। কারণ সে এখনো কথা বলতে পারে না এবং বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি, বিপদ বোঝে না, আগন্তুককে ভয় পায় না। এমনিতে দেখতে সে খুবই নরমাল এবং অনেকের মতে, বেশ সুন্দরও বটে। সে জন্ম থেকে এরকম নয়। কারণ সে মাত্র চার মাস বয়সেই প্রথম কথা বলা শুরু করেছিল। তখন যে কথাটা সে বলতে পারতো, সেটা হলো ‘গান’।
অর্থাৎ সে খুব ছোটকাল থেকেই গান শুনে অভ্যস্ত, আমরাই তাকে সে অভ্যাস করিয়েছিলাম। সে আসলে খুব যন্ত্রণা করতো, সে চাইতো যাতে আমরা তাকে সবসময় কোলে নিয়ে হাঁটি, দোলনায়ও থাকতে চাইতো না। কোলে ওঠার জন্য সে দেড় মাস বয়স থেকেই কোমর জাগিয়ে (বরিশালের আঞ্চলিক শব্দ, অর্থ – ‘তুলে’) দিতো। তাকে কন্ট্রোলে আনার জন্য আমি তাকে ৩ মাস বয়সে ৩২ ইঞ্চি এলইডি টিভি কিনে দেই এবং গান শোনার অভ্যাস করাই। গান শুনলে সে শান্ত থাকে, তাই তাকে গান শোনার অভ্যাস করিয়েছিলাম। যদি ওর মা আর নানী টিভিতে বেশিক্ষণ ধরে সিরিয়াল দেখতো, তবে ‘গান’ বলে চিল্লিয়ে উঠতো সে। এভাবেই সে মাত্র ৪ মাস বয়সে তার প্রথম শব্দ উচ্চারণ করে।
আমার সেই শিশুবাচ্চা যে চার বছর বয়সে এসেও কথা বলা শিখবে না, সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবি নি। আসলে বয়সের তুলনায় ও টিভি বেশি দেখে ফেলেছে, যার ফলে ওর মনস্তত্ত্ব জুড়ে কেবল গান আর টিভি। এছাড়া আমি বউ-বাচ্চাকে নিয়ে যৌথ ফ্যামিলিতে থাকতে পারি নি, বলতে গেলে পুরোটা সময়ই একা একা, নিউক্লিয়ার বা সিঙ্গেল ফ্যামিলি হিসেবে থেকেছি। দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সাথে থাকতে পারলে ও হয়তো কিছু কথাবার্তা শিখতো।
কথাবার্তা যেমন শেখে নি, ঠিক তেমনি বুদ্ধি-শুদ্ধিও হয় নি যথেষ্ট। এখন, একে নিয়ে বিপদে আছি। রাস্তায় ছেড়ে দিলে জোরে একটা দৌড় মারে। সামনে গাড়ি না মোটর সাইকেল, নাকি গরু বা মানুষ – কিছুই পরোয়া করে না; ছোট বাচ্চা দেখলেই জড়িয়ে ধরে। গানের পাশাপাশি আরেকটা জিনিস সে ভালোই শিখেছে, আর সেটা হলো ঘোরাঘুরি। ডেইলি তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে হবে, এটার জন্য সে আমাকে ভালোই ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। গ্রামাঞ্চলে (রূপগঞ্জ) যখন ছিলাম, তখন সেটা করতাম প্রায়ই, করোনার মাঝেও। কিন্তু এখন ঢাকা শহরে এসে সে সুযোগটাও নেই।
ওকে নিয়ে যে সমস্যাগুলো প্রচণ্ডভাবে ফেইস করতে হয়, তার মধ্যে একটি হলো চুল কাটা। চুল তো আর প্রতিবন্ধী বা সুস্থ মানুষ বোঝে না, চুল সবারই বড় হয়। আগে ওর নানী ব্লেড দিয়ে ওর চুল কেটে দিতো, আর সেটা করতে হতো ও যখন ঘুমাতো তখন। কিন্তু ৯-১০ মাস আগে সেটা করতে গিয়ে বাবুর মাথা কিছুটা কেটে যায় ব্লেড দিয়ে। কারণ চুল চাছার সময় হঠাৎ করে সে ঘুম থেকে উঠে বসে এবং মাথা ঝাঁকি দেয়। সে কাঁটা দাগ আমি দেখতে পাই কয়েকদিন পরে। সেটা দেখে আমি কিছুটা সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছিলাম এবং কীসব যেন বলে ফেলেছিলাম।
তখন ওর নানী প্রতিজ্ঞা করেন যে, আর বাবুর চুল কাটবেন না। ফলে তারপর থেকে বাবুর চুল কাটাতে হয় সেলুনে। গত বছরের নভেম্বরে সেটা করেছিলাম যখন ঢাকায় বেড়াতে আসি তখন। কারণ ভয় ছিল, চুল কাটানোর সময় যদি নড়াচড়ার ফলে ওর মাথার তালুতে কেটে যায় বা অন্য কোনোভাবে আহত হয়, তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে অতি দ্রুত। ঢাকা শহরে যেহেতু প্রচুর হাসপাতাল আছে, তাই ঢাকা শহরের সেলুনই তার চুল কাটার জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম।
এর পরে শেষবার তার চুল কাটাই গত মার্চে ২০ বা ২৫ তারিখের দিকে, করোনার ঝুঁকি নিয়েই (ওর মা’র একটা ঘাড়ত্যাড়ামির কারণে বাবুর চুল কাটা পিছিয়ে যায় প্রায় ১৫-২০ দিন, আর সম্ভাব্য বিপদের কথা চিন্তা করে আমার স্ট্রেসও বাড়তে থাকে)। এবার চুল কাটানো হয় রূপগঞ্জের একটি সেলুনে, কারণ ঢাকায় তখন করোনার ব্যাপক ঝুঁকি। এবার চুল কাটানোর সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ওর মাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রসিডিউরটা হলো এইরকম – আমি চেয়ারে বসবো এবং বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখবো। আর ওর মা শক্ত হাতে ওর মাথা ধরে রাখবে। গরু জবাই দেয়ার সময় যেরকম প্রস্তুতি নিতে হয়, অনেকটা ঐ রকম আর কি!
নাপিতের হাতে স্যানিটাইজার মাখিয়ে দিয়েছিলাম, পারলে অটোমেটিক মেশিনটাও স্যানিটাইজার দিয়ে ওয়াশ করি। কিন্তু সেটা তো ইলেকট্রিক যন্ত্র, সুতরাং সম্ভব না। তারপর চুল কাটা যখন শুরু হলো, তখন বাচ্চার সে কী ঝাকুঁনি এবং মোচড়ামুচড়ি! তার সাথে আমরা দু’জন – বাবা আর মা পেরে উঠছি না। তখন পাশে দাঁড়ানো আরেকজন, সে কি নাপিত না কাস্টমার না র্যান্ডম ব্যক্তি, সেটা আজও জানি না – সে এগিয়ে এলো সাহায্যে। বাচ্চার মা তার মাথা ছেড়ে দিল এবং ঐ ব্যাটা শক্ত করে সেটা ধরলো, আর আমিও তাকে আরো প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলাম। এভাবেই তার চুল কাটানো শেষ করলাম। রূপগঞ্জে ঐ ধরনের সেলুনে যেখানে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের চুল ২০-২৫ মিনিট ধরে কাটতে মাত্র ৫০ টাকা নেয়, সেখানে আমার কাছ থেকে সুযোগ পেয়ে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য নিলো ৭০ টাকা। যাক, সেটাও সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, অন্য যে ব্যাটা ভলেনটিয়ার করেছিল, সে করোনায় আক্রান্ত ছিল কিনা। সে সম্ভবত ছিল না, থাকলে তো আমরাও আক্রান্ত হতাম।
যাই হোক, বের হয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আবার হাতে স্যানিটাইজার মাখালাম। নাপিত ব্যাটাও তার যন্ত্রে খানিকটা তরল মাখিয়ে নিল, এমনকি বাচ্চার ন্যাড়া মাথায়ও বেশ খানিকটা স্যানিটাইজার মাখিয়ে ঘষে ডলে যথাসম্ভব জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কিছুটা ধন্যবাদও জানালাম, কাজটা কোনোরকম ইনজুরি ছাড়া করতে পারার কারণে। আর প্রার্থনা করতে থাকলাম, যাতে করোনায় আক্রান্ত না হই।
এরপর তো তিনমাস পার হয়ে গেছে, বাচ্চার চুল মোটামুটি বড় হয়ে গেছে, আবার কাটাতে হবে তার চুল। এখন না হলেও দু’মাসের মধ্যে তো নিশ্চিতভাবে। ভাবছি, একটা ইলেকট্রিক রেজার কিনবো, চুল কাটা মেশিন – যেটা দিয়ে নাপিতের দোকানে তার চুল কেটেছিল। কিন্তু আশংকায় আছি, সেটা দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে না জানি আবার কোন ঝামেলা বাঁধিয়ে বসি। ওটা দিয়ে যদি বাবা হয়ে নিজেই ছেলের মাথায় ইনজুরি করি, তাহলে তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাব? কোন হাসপাতাল ভর্তি নেবে আমার বাচ্চাকে? কারণ প্রথমেই তো তারা করোনা পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলবে। তাই বড় বিপদে আছি রে ভাই, এই অটিস্টিক বাচ্চাটাকে নিয়ে!